রাসু বড়ুয়ার প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘স্বপ্নভরা ছন্দছড়া’ শিশুকিশোর তরুণ সবারই মন ছুঁয়ে গেছে

65

সাঈদুল আরেফীন

রাসু বড়ুয়া। এই সময়ের তরুণ ছড়াশিল্পী। তুখোড় লেখক। নিয়মিত লিখছেন সংবাদপত্রে, সাহিত্য পাতায়, লিটলম্যাগে। কম সময়ের মধ্যেই তাঁর লেখনী শক্তি দিয়ে সবার মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। ছড়া কবিতায় তাঁর পারঙ্গমতা চোখে পড়ার মতো। ২০২২ এর একুশে বইমেলাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে রাসু বড়ুয়া গ্রন্থিত করেছেন প্রথম ছড়াকবিতা গ্রন্থ। চট্টগ্রামের স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শব্দশিল্প প্রকাশন থেকে এই গেলো ফেব্রুয়ারিতেই বেরুলো এই গ্রন্থটি। মোট ২৬টি ছড়া কবিতার সমন্বয়ে সময়ের তরুণ আলোচিত ছড়াকার রাসু বড়ুয়ার প্রথম প্রয়াস ছড়াগ্রন্থ ‘স্বপ্নভরা ছন্দছড়া’। বিগত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখেছেন রাসু বড়ুয়া। তরুণ ছড়াকার হিসেবে ইতোমধ্যে নিজের জাতটাকে ভালোভাবেই চিনিয়েছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। গ্রন্থটির নামকরণের সাথে রাসু বড়ুয়ার লেখাগুলোর যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ছড়াতেই আছে স্বপ্নময়তা। প্রকৃতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, উৎসব, পার্বন, শৈশব কৈশোরের দারুণ মাতামাতি ছন্দে ছন্দে দোলা খেয়েছে। এসবের মধ্যে পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেবার মতো অসংখ্য ছড়া কবিতা গ্রন্থভুক্ত হওয়াতে শিশুকিশোরদের পাশাপাশি বড়োরাও বেশ মজার খোরাক পাবে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে, বাংলার রূপ, রূপের খেলা, বৃষ্টি পড়ে, প্রবারণা, আঁকতে পারি, মেঘ জমেছে, সিংহ মামার বিয়ে, ঘুমপাড়ানি, বর্ণমালা, বাবা মায়ের পায়ের ধুলি, ছোট্ট খোকা, পয়লা বৈশাখ, সোনার ছেলে মুজিব, বসন্ত যেই আসে, ঈদের দিনে, শীতের রূপ, মা দুর্গা, খুকুর শখ, খোকাখুকির কলকাকলি, স্বপ্ন আমার, মেঘের সাথে আড়ি, দুরন্ত শৈশব, আঁকাআঁকি প্রভৃতি। প্রতিটি লেখাতেই রাসু বড়ুয়া পরিবেশ প্রতিবেশ চিহ্নিত করেছেন যাতে পাঠক নানা বৈষয়িক ভাবনার মধ্যে দিয়েই নিজেদের ডুবিয়ে দিতে পারেন তাঁর লেখার আঙিনায়। ছড়া কবিতাগুলো পাঠকের মনে এতোটাই আত্মোপলব্ধির জায়গা তৈরি করতে পেরেছে যে, প্রতিটি চরণ, পংক্তিতে ভিন্ন আমেজের দ্যোতনা প্রকাশ পেয়েছে। ঠিক তেমনি করেই রাসু বড়–য়া তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই বাংলার রূপ নিয়ে লেখা ছড়াতে বলেন-
‘উুঁচ মাথায় ঠায় দাঁড়িয়ে
গাছের পরে গাছ
নদী পুকুর জলাশয়ে
হরেক রকম মাছ’

‘বাংলার রূপ’ শীর্ষক এ ছড়াতে তিনি রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে এভাবে বর্ণনা করেন। অদ্ভূত সুন্দর উপমা উপস্থাপন করেছেন তিনি এতে। ঠিক সে রকমই তাঁর প্রকৃতি রূপের প্রতি অনুপম আকর্ষণ খুঁজে পাই আমরা আরো সুন্দরভাবে রূপের খেলা কবিতায়। তিনি যখন রূপের খেলায় উচ্চারণ করেন-
‘রোজ সকালে সূর্য ওঠে
পুব আকাশে দেখি
দিন গড়িয়ে ডুব দিয়ে যায়
পশ্চিমেতে সে কি!
রাত্রি এসে ঘুমিয়ে যায়
নিত্যদিনের মতো
সূর্য ওঠে দেয় বিলিয়ে
কিরণ অবিরত’

কবি প্রকৃতি মনস্কতার দিক দিয়ে লেখনী শক্তিকে অপূর্ব এক ব্যঞ্জনা দিতে চেয়েছেন তাঁর অন্ত্যমিলে তাঁর ছন্দে। বসন্ত যেই আসে ছড়াটিতে শীত শেষে বসন্তকে আহবান করেছেন ভিন্ন এক ভাষায়-
‘তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে
বলল শীতের বুড়ি
এবার সাজে পরবে মালা
হাতে কাঁকন চুড়ি’
এখানে লেখক কী সুন্দরভাবে একটা মৌসুম শেষে আরেকটা মৌসুমের আগমনী বার্তা উপমা দিয়ে দারুণভাবে পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই কবিতার আরেকটা পংক্তি পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাবার মতো-
‘হলুদ হলুদ সরষে ফুল
প্রজাপতির মেলা
মৃদু বাতাস সঙ্গী হয়ে
করছে খুশির খেলা।

একটা শিশুসন্তানের জন্য মা অনেক বড় ধন। মায়ের সাথে শিশুর সোহাগমাখা আদর যতেœ লালনের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এঁকে দিয়েছেন কবি ছড়াকার রাসু বড়ুয়া। তিনি যখন মেঘ জমেছে ছড়াটির শুরুতে বলেন-
মেঘের পরে মেঘ জমেছে
আকাশবুকে ওই
মা ডেকে কয়- খোকন সোনা
কই গেলিরে কই?
এখানে কবি মেঘের ঘনঘটায় তার শিশুপুত্রের অবস্থান জানার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। তাতেই কবি ক্ষান্ত হননি শেষ পংক্তিতে কবি যখন বলেন-
মা ডেকে যায়, বুকের মানিক
আয়রে বাড়ি আয়
দেখিস না তুই মেঘ করেছে
দূরের আকাশটায়।

ঠিক এমনই মায়ের মমতা জড়ানো আকুতি খুঁজে পাই আলোচ্যগ্রন্থের ঘুমপাড়ানি ছড়াটির পরতে পরতে। এখানে কবি এমনভাবে পরিবেশ তৈরি করেছেন যাতে মমতাময়ী মা সহ শিশুকিশোরদের যথেষ্ট মায়া ছড়াবে লেখাটিতে-
চাঁদের দেশের ঘুমপরীরা
নামল সেজে কবে
হেলেদুলে ডানা মেলে
গান ধরেছে সবে
পরবতীতে প্যারাতে এভাবে ছড়াটি আসে-
মায়ের সোহাগ আদর পেয়ে
সোনা ঘুমের ঘোরে
আঁধার ভেঙে উঠবে জেগে
মধুর আশার ভোরে।

মায়ের সাথে বাবাকেও কবি এনেছেন ভিন্ন আঙিকে বাবা মায়ের পায়ের ধুলি কবিতাটিতে কবি যখন এভাবে বলেন-
মা ধরেছেন পেটে আমায়
বাবা জন্মদাতা
তাঁদের শ্রমেই রঙিন হলো
আমার জীবনখাতা।

কবি রাসু বড়ুয়া গ্রন্থটির প্রতিটি ছড়া কবিতার পরতে পরতে পাঠক মাত্রকেই তাঁর নিজস্ব স্বকীয় ধারাটি বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন খুব ভালোভাবেই। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসু বড়ুয়া মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন আন্তরিকতার সাথেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শিশুমানস গঠন, শিশুদের ফুল-ফল আর ছবির সাথে মেলবন্ধন ঘটানো, আকাশ-প্রকৃতি, ঈদ পুজা-পার্বণ, ষড়ঋতুর নানাদিকের সুবিন্যস্ত বিষয়গুলোকে চমৎকারভাবে ধারণ করে এনেছেন কবি রাসু বড়ুয়া। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হিসেবে বিষয়বস্তুর সবদিক টেনে এনে আলোচ্য গ্রন্থটিকে সত্যিকার অর্থেই নান্দনিকতা প্রদানে সক্ষম হয়েছে। ছন্দ, মাত্রা, অন্ত্যমিল সবদিক দিয়ে রাসু বড়ুয়া তরুণ হিসেবে নিজের নামের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করেছেন, বলতে পারি। আর পাঠকদের প্রতি অনুরোধ সুমিষ্ট এই ছড়াগ্রন্থটি পড়ুন শিশুকিশোর তরুণ সবারই মন কাড়বে নিঃসন্দেহে। তবে আগামীতে আরো সচেতন হয়ে ভিন্নধারার অন্ত্যমিল সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হতে হবে কবিকে। সেই সাথে গতানুগতিক ধারাকে ভেঙ্গে নিত্য নতুন ধারণার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারলে রাসু বড়ুয়াই হয়ে উঠবেন আমাদের আগামীদিনের নন্দিত ছড়াশিল্পী। চট্টগ্রামের নন্দিত প্রকাশক শব্দশিল্প প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক বিশিষ্ট কবি ও ছড়াশিল্পী এমরান চৌধুরীকে ধন্যবাদ দিতেই হয় চট্টগ্রাম তথা দেশের সাহিত্যাঙ্গনে উপহার দিলো তরুণ মেধাবী একজন ছড়াকার যাকে তুলে ধরেছেন যথাসময়ে। ছাদির হুসাইনের সুন্দর প্রচ্ছদে ফারজানা পায়েলের মনোমুগ্ধকর অলঙ্করণে ‘স্বপ্নভরা ছন্দছড়া’ গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছে মাত্র ২২০ টাকা।