রাষ্ট্রভাষা ও বর্তমান বাংলা ভাষা

34

শওকত এয়াকুব

১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শোষকদের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে বাঙালি ছিল সোচ্চার। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৫২ সালে একুশে ফেব্রæয়ারি আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে পৃথিবীতে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। পাকিস্তানিরা সেদিন আমাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল। সত্যিই বাংলা ভাষা আমাদের অহঙ্কারের। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ভাষা যে একটি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন, তা বাঙালি জাতি জীবন উৎসর্গ করে প্রমাণ করেছে। বর্তমান বিশ্বে সমৃদ্ধিশালী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু যে ভাষার জন্য রফিক, বরকত, সালামরা প্রাণ দিলেন, যার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন বেগবান ও সফল হলো, সর্বক্ষেত্রে সে ভাষার ব্যবহার আজও সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, সরকারি সিদ্ধান্তও আছে; কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ সেভাবে দেখা যায়না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার বিকৃতি ও অপব্যবহার বেড়েই চলেছে। ভাষার যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা আর সর্বজনীনতার ওপর ভাষার সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। সমৃদ্ধি না ঘটলে ভাষা দীন হতে থাকে, একসময় বিলুপ্তি ঘটে। পৃথিবীতে ভাষার মৃত্যু বা বিলুপ্তির এ রূপ অনেক উদাহরণ আছে। বর্তমানে বাংলা চর্চার যে অবস্থা তাতে, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে। নানান দিক থেকে বিপদ তৈরি হয়েছে। সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণির বাংলাচর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে।বাংলা ভাষা ক্রমেই এক ধরনের বিকৃতি ও একটি ক্ষয়ের পর্ব অতিক্রম করছে। কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত, অন্যদিকে, ইংরেজি শব্দের অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। এছাড়া ও আছে বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ভাষার ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার প্রভৃতি। বিশ্বায়ন, আকাশ, সংস্কৃতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা শব্দ ও বাক্যগুলোকে মজার ছলে বা নিজের অজান্তেই ব্যবহার করছেন অনেকেই। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষার এমন বিকৃত রূপ প্রায় নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু বাড়ছেই না। বরং নতুন নতুন ঢঙে বিকৃত হচ্ছে মৌলিক বাংলা শব্দগুলো। এছাড়া ও টেলিভিশন, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখছে প্রতিনিয়ত। যার প্রভাব পরীক্ষার খাতায়ও দেখতে পাওয়া যায়! কিন্তু কোনো মহল থেকেই এর কোনো প্রতিবাদ ওঠছে না।ভাষা বিকৃত করার প্রবণতা তরুণদের মধ্যে বেশ লক্ষণীয়। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভাষাপ্রেম তেমন ফুটে উঠেছে না। পরিবেশে নিজেকে একটু শিক্ষিত বা মার্জিতভাবে উপস্থাপন করার জন্য বাংলা ভাষার মধ্যে ইংরেজি ব্যবহার করেন। কিন্তু তাদের সামনে এক জন কৃষক কিংবা রিকশাচালক যদি খাঁটি বা আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় কথা বলেন তখন তথাকথিত শিক্ষিতরা তাদের ক্ষেত বলে। অফিস-আদালত, চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপনসহ প্রায় জায়গাতেই চলছে বিদেশি ভাষার ব্যবহার। বিদেশি ভাষার আগ্রাসনে খাঁটি বাংলা ভাষার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে।সবচেয়ে বড় আফসোসের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে কিছু সুশীল ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা টকশো কিংবা প্রেরণা বক্তৃতায় (মোটিভেশনাল স্পিচ) বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। যার প্রভাব পড়ে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে।
বাংলাভাষা আমাদের অত্যন্ত আবেগ ও মর্যাদার। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাভাষা ক্রমেই মর্যাদা হারাচ্ছে। একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করান না। শহরে-নগরে তো বটেই, শহরতলি এমনকি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি শিক্ষার্থীসংকটে ভুগছে।মফস্বলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে। গরিব, প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরা শুধু এখন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে।বাড়ছে ইংরেজির দাপট। বাংলা ক্রমেই হয়ে পড়েছে গরিবের ভাষা।
বর্তমান বাংলাদেশে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিকৃতি চলছে, এর গতিরোধ করতে না পারলে বাংলা ভাষা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তির পথে চলে যাবে। ভাষাবিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে যত দাপুটে ভাষা আছে, এগুলোয় বানানের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। বাংলা বানানের ক্ষেত্রে নিয়ম রয়েছে। বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম মেনে এ ধরনের ভুল সহজেই এড়ানো যায়। বিকৃত উচ্চারণে বাংলার সঙ্গে বিদেশি শব্দের মিশ্রণ করে কথা বলাটাকে অনেকে গৌরবের মনে করেন। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যত্রতত্র বাংলা বানানে ভুল ভাষার জন্য অমর্যাদাকর। আমরা যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি, ওই ভাষাকে অবদমিত করা ঠিক নয়। যারা বাংলা ভাষাকে নিজেদের মতো করে বিকৃতভাবে ব্যবহার করছেন, তারা ভাষার গুরুতর ক্ষতি করছেন। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিশ্বদরবারে আমরা বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পরিচিতি লাভ করেছি। বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে হলে আমাদের উচিত সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করা। যে জাতি তার দেশ ও ভাষাকে যত বেশি মর্যাদা দেবে, ওই দেশ তত বেশি উন্নত হবে। আমরা যেমন মাকে ভালোবাসি, তেমনি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি। তাই তো মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিতে পিছপা হয়নি বাঙালি জাতি। রফিক,সালাম,বরকত, জব্বারসহ অনেকে জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা রক্ষা করেছেন। আমরা কেন পারব না বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে। লর্ড চেস্টারফিল্ডের মতে, ‘ভাষা হচ্ছে মন্দিরের মতো-যেখানে আত্মা বিচরণ করে’।বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক