রানির মৃত্যুর ১০ দিন পর ‘অপারেশন লন্ডন ব্রিজ’

6

 

গত ৮ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এদিন দুপুরে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তার আগে দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে ব্রিটিশ সিংহাসনের রানি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ফেব্রæয়ারিতে বাবা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর ২৫ বছর বয়সে বসেছিলেন সিংহাসনে। তারপর পেরিয়ে গেছে ৭০ বছর পেরিয়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনামলের সমাপ্তি ঘটল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু সংবাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় থেকে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত ঘটনাগুলো আগে থেকেই ঠিকঠাক করা আছে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু হলে সে খবর ছড়িয়ে পড়বে মাত্র একটি বার্তায়। সেটা নির্ধারণ করা ছিল, লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন (London Bridge Is Down । রানির প্রাইভেট সেক্রেটারি এই বার্তা পাঠাবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে। লন্ডনে রানির মৃত্যু এবং শেষযাত্রায় সংকেতেই চলবে প্রশাসনের কাজ। তবে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। রানির মৃত্যুতে ব্রিটেনে এখন অপারেশন ইউনিকর্ন (Operation Unicorn) কোড ব্যবহার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর জানায়, লন্ডনের পরিবর্তে স্কটল্যান্ডে রানির মৃত্যু হওয়ায় তার পরে সমস্ত কাজের ক্ষেত্রে এই কোড ব্যবহারের কথা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। স্কটল্যান্ডের জাতীয় পশু ইউনিকর্ন। রয়্যাল কোট অফ আর্মসেও ব্রিটিশ সিংহের সঙ্গে থাকে এই ইউনিকর্ন। গত ৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদের মৃত্যুবরণ করেন রানি এলিজাবেথের। তারপর থেকেই অপারেশন ইউনিকর্ন অনুসারে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রশাসন।
অপারেশন ইউনিকর্ন কি?
ব্রিটেনের রানির অন্যতম প্রিয় আবাস ছিল স্কটল্যান্ডের এই বালমোরাল প্যালেস। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, ২০১৭ সালে এডিনবার্গের পার্লামেন্টের অনলাইন নথিতে প্রথম এই ‘অপারেশন ইউনিকর্ন’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। রানি স্কটল্যান্ডে মারা গেলে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এডিনবার্গের প্রাসাদ, গির্জায় যে জন¯স্রোত তৈরি হবে, সেই প্রসঙ্গও ছিল ওই পুরনো নথিতে। পরিকল্পনা অনুসারে রানির মরদেহ এডিনবার্গের প্রাসাদে আনা হবে। সেখান থেকে ট্রেনে দেহ পৌঁছবে লন্ডনে। রানির প্রয়ানের দিনটিকে ডি ডে বলে উল্লেখ করা হবে নথিতে। পরবর্তী শোকের দিনগুলিকে ডি-১ ডি-২ বলে চিহ্নিত করেই চলবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা। অপারেশন ইউনিকর্ন অনুসারে মৃত্যুর পর স্কটল্যান্ড থেকে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে আনা হবে রানির মরদেহ। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর বালমোরাল প্যালেস থেকে এডিনবার্গের রাজপ্রাসাদে আনা হবে রানির কফিন। এডিনবার্গের প্রাসাস থেকে সেন্ট জাইলস ক্যাথিড্রাল পর্যন্ত শোক মিছিলও হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর রয়্যাল ট্রেনে শেষবারের মতো এডিনবার্গ থেকে লল্ডন ফিরবেন রানি এলিজাবেথ। স্টেশনে উপস্থিত থাকবেন নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। লন্ডনে পৌঁছনোর পর বাকিংহাম প্যালেসে রাখা হবে রানির মরদেহ। মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় রানির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। King George VI Memorial Chapel-ই সমাধিস্থ করা হবে ব্রিটেনের সম্রাজ্ঞীকে। আর সেই সঙ্গেই শেষ হবে অপারেশন ইউনিকর্ন।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে ক্ষমতার পালাবদলের নিয়ম
মায়ের মৃত্যু পর রানির বড় ছেলে চার্লস স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন রাজা হয়েছেন। বর্তমানে তার বয়স ৭৩ বছর। বিশ্বজুড়ে সব সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ব্রিটিশ রাজপরিবার। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসও সবারই জানা। সেই ইতিহাস বিস্মৃত না হলেও ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের পরিধি এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। তবে তাদের রাজপরিবার নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনও কমতি নেই। ব্রিটিশ রাজ্যের ইতিহাস বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ব্রিটিশ শাসনের সময়কালকে বোঝায়। এই শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্রিটিশ রাজ বা রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। যুগে যুগে তাদের ক্ষমতার বদল ঘটেছে। তবে তা পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেননা ব্রিটিশ রাজপরিবারের ক্ষমতা মূলত রাজা থেকে রাজার সন্তানের কাছে পৌঁছায়। কোনও রাজা বা রানি যদি মারা যান, তাহলে তার সন্তানের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড়; তিনি ক্ষমতায় বসবেন। সে হিসেবে, রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর তার মেয়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন। এর আগে রাজা ষষ্ঠ জর্জ তার বাবা পঞ্চম জর্জের পর দেশটির রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারও আগে ব্রিটিশ সিংহাসনে ছিলেন রাজা পঞ্চম জর্জের মা রানি ভিক্টোরিয়া। তখন বাবা-মায়ের ছেলে সন্তান না থাকায় রানি ভিক্টোরিয়া ও দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। কারণ রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী, উত্তরসুরীদের মধ্যে যদি ছেলে-সন্তান থাকে এবং সে যদি বয়সে মেয়েদের চেয়ে ছোটও হয়, তারপরও তিনিই রাজ সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু ২০১৫ সালে প্রিন্স উইলিয়ামের মেয়ে প্রিন্সেস শার্লোটের জন্মের পর এ আইনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে প্রিন্সেস শার্লোট তার ভাই প্রিন্স লুইসের আগে সিংহাসনে বসতে পারবেন, যদি তার তেমন সুযোগ হয়। বর্তমানে ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে আছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বড় ছেলে এবং প্রিন্স উইলিয়ামের বাবা প্রিন্স চার্লস। তার পরেই প্রিন্স উইলিয়াম সিংহাসনে বসতে পারবেন। প্রিন্স উইলিয়ামের পরে সিংহাসনের দাবিদার তার ছেলে প্রিন্স জর্জ, প্রিন্সেস শার্লোট এবং প্রিন্স লুইস। সেই হিসেবে প্রিন্স হ্যারির ব্রিটিশ সিংহাসনে বসার কোনও সম্ভাবনা নেই।
রানির মৃত্যুতে বিশ্ব নেতাদের শোক
বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তারা রানির গভীর কর্তব্যবোধ ও দৃঢ়তার পাশাপাশি তাঁর রসবোধ এবং মমতার কথা স্মরণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে সফরের কথা স্মরণ করে বাইডেন বলেন, ‘তিনি তার প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন। উদারতা দিয়ে করেছিলেন আলোড়িত। উদারভাবে তিনি তার প্রজ্ঞা আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ’ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে ১৩ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি রানির ‘উদার বন্ধুত্ব, দুর্দান্ত প্রজ্ঞা এবং বিস্ময়কর হাস্যরসের অনুভূতি’ কখনই ভুলবেন না। ট্রাম্প তার নিজের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যাল-এ লিখেছেন, ‘তিনি এক দুর্দান্ত এবং সুন্দরী নারী ছিলেন-তার মতো কেউ ছিল না!’ আরেক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, রানি ‘করুণা, কমনীয়তা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমর নীতিতে পরিচালিত’ রাজত্ব দিয়ে বিশ্বকে মোহিত করেছিলেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, তিনি ছিলেন এক ‘সদয়-হৃদয় রানি’ যিনি ‘ফ্রান্সের বন্ধু’ ছিলেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, তার ‘কানাডীয়দের প্রতি গভীর এবং সাশ্বত ভালবাসা ছিল। ’ রানি এলিজাবেথ কানাডার নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। রানি তার শাসনামলে দেশটিতে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেন, ‘একটি জটিল বিশ্বে, তার নিষ্কম্প করুণা এবং সংকল্প আমাদের সবার জন্য স্বস্তি এনেছে। ’
রাজ পরিবারের প্রতি ভালবাসা অটুট রাখতে
সচেষ্ট ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দীর্ঘ রাজত্বকাল জুড়ে ছিল তাঁর কঠোর কর্তব্যপরায়ণতা এবং ব্রিটিশ সিংহাসন ও ব্রিটিশ জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনকে নিবেদন করার ব্যাপারে তাঁর নিষ্ঠা ও অঙ্গীকার। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনও অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন একজন ধ্রæবতারা। উত্তাল নানা সময়ের মধ্যেও ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে তিনি যেভাবে টিকিয়ে রেখেছেন তা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। তাঁর বাবা অ্যালবার্ট, ডিউক অফ ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ -লিওন-এর তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। অ্যালবার্ট ছিলেন পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান। এলিজাবেথ এবং তাঁর বোন মার্গারেট রোজ দুজনেই লেখাপড়া শিখেছেন বাড়িতে। মার্গারেটের জন্ম হয় ১৯৩০ সালে। পরিবারের ভালবাসার আবহে বেড়ে উঠেছিলেন দুই বোন। বাবা অ্যালবার্ট এবং দাদা পঞ্চম জর্জ দুজনেরই খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন এলিজাবেথ। রানির যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর ঘোড়ায় চড়া বিষয়ক প্রশিক্ষককে তিনি বলেছিলেন তিনি “গ্রামের গৃহিণী হতে চান যার অনেকগুলো ঘোড়া ও কুকুর থাকবে।” বলা হয় খুবই ছোটবেলা থেকেই তিনি অসাধারণ দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন ।
দায়িত্বে অটল- দু হাজার ১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আসীন থাকার গৌরব অর্জন করেন। তবে এই গৌরব নিয়ে রানি কখনও বাড়াবাড়ি করেননি। তাঁর নিজস্ব বিনয়ী স্টাইলে তিনি বলেছিলেন এমন কোন “সম্মান অর্জনের লক্ষ্য আমার কখনই ছিল না”। এর এক বছর পর ২০১৬ সালে রানি তাঁর ৯০ বছরের জন্মদিন পালন করেন। নব্বই বছর পার করেও তিনি তাঁর রাজ দায়িত্ব চালিয়ে গেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর স্বামী ডিউক অফ এডিনবারা, প্রিন্স ফিলিপ অবসর নেবার পরেই তিনি একাই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন।
কেন দস্তানা ও টুপি পরে থাকতেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছিল উজ্জ্বল রঙের টুপি ও হালকা রঙের দস্তানা। রাজা-রানিদের কথা উঠলেই প্রথমে মাথায় আসে যা খুশি তাই করার স্বাধীনতার কথা। কিন্তু অন্তত পোশাকের দিক থেকে ভাবলে, মোটেও এমন স্বাধীনতা নেই ব্রিটেনের রাজপরিবারের সদস্যদের। অধিকাংশ সময়েই মেনে চলতে হয় কড়া পোশাকবিধি। রানি নিজেও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কোনও লিখিত আইন না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যই হয়ে গিয়েছিল নিয়ম। সিংহাসনে বসার পর থেকে খুব সচেতন ভাবেই নিজের পোশাক বাছতেন রানি। ১৯৪৭ সালে যুবরাজ ফিলিপের সঙ্গে বিবাহের পর থেকে নরম্যান হার্টনেল, হার্ডি অ্যামিস ও অ্যাঞ্জেলা কেলি নামের তিন পোশাকশিল্পী সামলেছেন রানির পোশাকের দায়িত্ব। অল্প বয়সে রানিকে দেখা যেত সাদা গাউনে। শেষ কয়েক দশক সেই পোশাকের বদলে অধিকাংশ সময় তাঁকে পরতে দেখা গিয়েছে উজ্জ্বল রঙের স্কার্ট। রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী সেই স্কার্টের দৈর্ঘ্য হতে হবে একেবারে হাঁটু পর্যন্ত। না কম, না বেশি। তবে স্কার্ট পরলেও পা যেন অনাবৃত না থাকে কোনও মতেই, তা নিশ্চিত করতে হত। রাজপরিবারের যে কোনও মহিলা সদস্যেরই ‘টাইটস’ পরা বাধ্যতামূলক। টাইটস হল এক ধরনের লম্বা পা ঢাকা মোজার মতো পোশাক যা একেবারে চামড়ার সঙ্গে লেগে থাকে। পাশাপাশি ব্রিটেনের রাজপরিবারের রীতি অনুযায়ী যিনি এই টাইট পরবেন, তাঁর ত্বকের রঙের সঙ্গে অবিকল এক হতে হবে টাইটের রং। সাধারণত যে রঙের পোশাক পরতেন রানি, সেই রঙেরই টুপি পরতে দেখা যেত তাঁকে। সিংহাসনে বসার প্রথম দিকে, জনসমক্ষে আসলেই টুপি পরা ছিল বাধ্যতামূলক। কারণ ব্রিটিনের রাজকীয় আচরণশৈলী অনুযায়ী, রানির আলুলায়িত চুল দেখতে পাওয়া ঘোর অনিয়মের বিষয়। তবে কালের নিয়মে সেই রীতি বদলে গিয়েছে।
শেষ কয়েক দশক ধরে আর ব্যক্তিগত পরিসরে টুপি বা মুকুট পরতেন না রানি। রাজবাড়ির কর্মচারীদের কেউ কেউ অবশ্য বলেন, টুপি পরতে মোটেই অপছন্দ করতেন না তিনি। বরং টুপি পরলে অনেকের মাঝে থাকলেও দূর থেকে দেখা যেত পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এলিজাবেথকে। যা বেশ পছন্দই করতেন তিনি। দস্তানার নিয়মটির পিছনে অবশ্য বিজ্ঞানচেতনা রয়েছে বলে দাবি করেন পোশাকশিল্পীদের কেউ কেউ। রানি প্রতি দিন দেশ-বিদেশের বহু মানুষের সঙ্গে দেখা করেন, হাত মেলান। যাতে অন্যের হাত থেকে রোগজীবাণু হাতে না লেগে যায় তার জন্যই নাকি দস্তানার বন্দোবস্ত। পোশাক পরিচ্ছেদের ক্ষেত্রে রং-ও ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনও ধরনের রাজনৈতিক বার্তা বহন করে, এমন রঙের কোনও পোশাক পরা রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য একেবারে নিষিদ্ধ। যদি রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে যোগ দিতে যান, তবে অবশ্যই পরতে হবে কালো রঙের পোশাক। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও আজীবন মেনে চলেছেন এই নিয়ম। এমনকি, নেলপলিশের ক্ষেত্রেও মেনে চলতে হত কড়া নিয়ম। মৃদু গোলাপি ছাড়া সাধারণত আর কোনও রঙের নেলপলিশ পরতেন না রানি।
রাজকুমার ফিলিপের সঙ্গে দাম্পত্য ছিল অটুট
রাজপরিবারের একজন একান্ত সচিব একবার বলেছিলেন, ‌‘সারা বিশ্বে প্রিন্স ফিলিপ একমাত্র মানুষ যিনি রানিকে নেহায়েত অন্য একজন মানুষ হিসাবে দেখেন এবং সেভাবেই তার সাথে ব্যবহার করেন। একমাত্র তিনিই এটা করতে পারেন।’ তাদের বিয়ে ছিল প্রেমের। দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তাদের দেখা হয়েছিল বিয়ের অনেক আগেই।
ডার্টমথ নেভাল কলেজে ১৯৩৯ সালে তোলা ছবি দেখে বোঝা যায় রাজকীয় এই পেপ্রম-প্রণয়ের সূচনা তখন থেকেই। প্রিন্স ফিলিপ তখন ১৮ বছরের সুদর্শন চনমনে নেভাল ক্যাডেট। বাবা-মার সাথে ওই কলেজ সফরে গিয়ে ১৩ বছরের রাজকুমারী এলিজাবেথের নজর কাড়েন তিনি। কৈশোরের সেই আকর্ষণ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে রূপ নেয়। দু’জন দু’জনকে চিঠি লিখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎ মাঝেমধ্যে দেখাও হতো দু’জনের। প্রিন্স ফিলিপ যখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তরুণী রাজকুমারী তার ঘরে প্রিন্স ফিলিপের একটি ছবি রেখেছিলেন। গ্রিস এবং ডেনমার্কের এই রাজকুমারের ছেলেবেলা ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো। তার জন্ম গ্রিসের রাজপরিবারে, কিন্তু নির্বাসিত হওয়ায় ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরতে হয়েছে তাকে। এ কারণে অল্প বয়স থেকে তিনি ছিলেন অনেক স্বাবলম্বী এবং শক্ত মনের। রাজকুমার হলেও রাজপ্রসাদের ছায়া তার ওপর ছিল না। রাজকুমারী এলিজাবেথ ছিলেন তার বিপরীত। তার জন্ম এবং বড় হওয়া ছিল রাজপ্রাসাদের সুরক্ষিত বেষ্টনীর ভেতর। বাইরের জীবনের বাস্তবতার সাথে তার পরিচয় ছিল খুব সামান্য। চুপচাপ লাজুক স্বভাবের ছিলেন তিনি। যে কোন বিষয় নিয়ে অনেক ভাবতেন।
রাজকুমারীর যখন বিশ বছর, প্রিন্স ফিলিপ তখন বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এক বছর পর ১৯৪৭ সালে এলিজাবেথের ২১তম জন্মদিনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বাগদানের কথা প্রকাশ করা হয়। প্রিন্স ফিলিপ, তার মা গ্রিসের রাজকুমারী এলিসের মাথার টিয়ারা থেকে নেয়া হীরার টুকরো দিয়ে নিজে বাগদানের আংটির নকশা করে দিয়েছিলেন। বিয়ের আগে তিনি এলিজাবেথের মায়ের কাছে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, এলিজাবেথের প্রতি শতভাগ দ্বিধাহীন প্রেমে নিমজ্জিত তিনি। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় দুই হাজার অতিথির সামনে তাদের বিয়ে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র দু’বছর আগে। ব্রিটেন তখনও সেই ধাক্কা সামলাতে বিপর্যস্ত। সেই কঠিন সময়ে বিয়ে নিয়ে অনেকদিন পর ব্রিটিশরা উৎসব করেছিলেন। রাজপ্রাসাদের বাইরে সেই দাম্পত্য জীবন ছিল অনেক স্বাভাবিক, স্বাচ্ছন্দ্যের এবং উচ্ছলতায় ভরা। ভূমিকার এই বদলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে কোনো সমস্যা দেখা দিলেও তা কখনই ঘরের চার দেয়ালের বাইরে বের হয়নি।
দায়িত্বের কারণে রানিকে অধিকাংশ সময় লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে থাকতে হতো। সন্দেহ নেই যে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময় দু’জনে দুই জায়গায় থাকতেন।
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দু’জন দু’জনের সাথী ছিলেন।
৮৬ বছর বয়সেও চমক দিয়েছিলেন
লন্ডনের অলম্পিক স্টেডিয়ামকে
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পক্স উপলক্ষে হলিউডের জেমস বন্ড খ্যাত অভিনেতা ড্যানিয়েল ক্রেগের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে। আদতেই বর্ণময় জীবন ছিল তাঁর। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক্স উপলক্ষে জেমস বন্ড সিরিজের অভিনেতা ড্যানিয়েল ক্রেগের সঙ্গে একটি ভিডিয়োয় ‘ক্যামিও রোলে’ দেখা গিয়েছিল রানিকে। প্যারাসুটে দেখে মনে হয়েছিল রানির মতো কেউ নামছেন। দূর থেকে দেখে বোঝাও যাচ্ছিল না, রানি না অন্য কেউ। প্যারাসুট যখন থামে, তখন দেখানো হয় রানিকে। অনেকেই চমকে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে, এই বয়সে রানি প্যারাসুটে করে নামলেন! আসল ঘটনা ছিল অন্য। প্যারাসুটে রানির বেশে ছিলেন এক ব্যক্তি। তার পর যখন প্যারাসুটটি নামে, তখন রানিকে দেখানো হয়। তবে এই ছবি লন্ডন অলিম্পিক্সের এক ‘বৈগ্রহিক’ ছবি হিসাবে বিবেচিত।