রাজনৈতিক মামলায় আগ্রহী পুলিশ, মাদকে উদাসীন

36

রাজনৈতিক মামলায় পুলিশের অতি আগ্রহী তৎপরতার বিপরীতে মাদকের মামলার আসামির ক্ষেত্রে রহস্যময় উদাসীনতা দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের আগে কারাগারে আটক বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘নাশকতার’ মামলায় আদালতে শ্যোন অ্যারেস্ট বা গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে পুলিশের করা আবেদনের হিড়িক পড়লেও তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে তেমনটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমনকি, ওই আসামির বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় জারি থাকা পরোয়ানার তথ্যও নেই আদালতের নথিতে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযানের মুখে দেশত্যাগ করা নগর পুলিশ ও র‌্যাবের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মো. ইউসুফের প্রধান সহযোগী দেড় ডজনেরও বেশি মামলার আসামি মো. শাকিলকে গত ৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানা পুলিশ সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে।
নগরীর সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া পৃথক তিনটি মামলায় জারি হওয়া পরোয়ানামূলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে স্থানীয় আদালতে হাজির করার পর তাকে সেখানকার জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করে। সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর ওই আসামিকে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে তাকে ফের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আদালতের নিবন্ধন (জিআর) শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মো. শাকিলের মামলার নথিতে শুধুমাত্র সদরঘাট থানায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলার কাগজপত্রই রয়েছে। অথচ, ওই তিনটি মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে একই থানায় আরও দুটি মামলা, খুলশী থানায় একটি এবং ডবলমুরিং থানায় দায়ের হওয়া পৃথক সাতটি মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। এসব মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে এখন পর্যন্ত কোনও থানার পুলিশ আদালতে আবেদন করেনি। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের একজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পরও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে পুলিশের এই রহস্যজনক উদাসীনতা সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অপরদিকে আদালতে থাকা মামলার নথি অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় পুলিশ নাশকতার অভিযোগে মামলা করে দুইশ’ ৩২টি। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর মাসেই দায়ের করা হয়েছে একশ’ তিনটি মামলা। এছাড়াও সেপ্টেম্বরে ৪৭ ও নভেম্বরে ২৫টি নাশকতার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করেছে পুলিশ। এজাহারে নাম না থাকলেও অনেককে সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদনও করেছে পুলিশ।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাতে নগরের ডবলমুরিং থানার পূর্ব মুহুরীপাড়া ছোট মসজিদ গলির পাশে ককটেল ছোড়ার ঘটনায় করা মামলায় উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড বিএনপির আহব্বায়ক এসএম ফরিদুল আলমকে আসামি করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। অথচ, তিনি নাশকতার মামলায় তারও আগে গত বছরের ২৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বিষয়টি জানাজানির পর পুলিশ আদালতে ক্ষমা চেয়ে মামলার এজাহার থেকে ফরিদুলের নাম বাদ দিতে লিখিতভাবে আবেদন করেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৭ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালত এলাকা থেকে মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনে বিএনপির মনোনয়নে প্রার্থী হওয়া শাহাদাতের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় নাশকতার অভিযোগে মোট ৩০টি মামলা ছিল। সবকটিতে তিনি জামিনেও ছিলেন। এরপর তাকে গত ২১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ দিনে নগরের বিভিন্ন থানায় পুলিশের দায়ের করা ১১টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। সবকটি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে তার জামিনের নথি গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে এসে পৌঁছায়। ওইদিনই গত অক্টোবরে নাশকতার অভিযোগে কোতোয়ালী থানায় দায়ের হওয়া আরেকটি মামলায় ডা. শাহাদাতকে গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদনও জমা করে পুলিশ। ওইদিন শুনানি না হওয়ায় তার কারামুক্তি আটকে যায়।
পুলিশ কর্মকর্তারা নাশকতার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলো নিয়ে পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি নন। তবে, একাধিক কর্মকর্তা আলাপকালে জানান, মামলা রেকর্ড ও আসামি গ্রেপ্তার হলেও নাশকতার মামলাগুলোর তদন্তে তেমন আগ্রহ নেই তদন্ত কর্মকর্তাদের। তাই তারা ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছেন।
রাজনৈতিক ও মাদকের মামলার আসামির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে পুলিশের ‘দ্বিচারিতার’ বিষয়টি নজরে আনলে সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখানে স্বার্থ কিংবা লাভালাভের বিষয় থাকতে পারে। পুলিশের এ ধরনের অবস্থান রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার জন্য রীতিমত হুমকি। এমনকি, দেশের বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার ওপরও জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। অপরদিকে, শৃংখলা বাহিনীর পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অস্বাভাবিক নয়।