রাজনৈতিক আশ্রয়ে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ

171

হাটহাজারীর বিভিন্ন পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন লক্ষাধিক মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী এসব মানুষকে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের জন্য এখনও কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালের ১১ জুন (তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়) চট্টগ্রাম সেনানিবাস সংলগ্ন উপজেলাধীন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দক্ষিণ জঙ্গল পাহাড়তলী এলাকার লেবু বাগান ও কাইচ্ছাঘোনায় স্মরণকালের ট্র্যাজেডি পাহাড়ধস ও মানবিক বিপর্যয়ের পর প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিগুলো সরানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু তা সরকার পরিবর্তনের পর আর বেশি দূর এগোয়নি। আবার প্রশাসনের নীরবতাকে পুঁজি করে ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছে বলে জানা গেছে।
প্রতি বছর বর্ষা এলেই স্বল্প সময়ের জন্য প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পাহাড়ে ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের ঝুঁকিপুর্ণ ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে রুটিন ওয়ার্ক শেষ করেন। এছাড়া পাহাড়ধসের মত ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে তাদের কার্যক্রমে পরে ভাটা। ভূমিহীন মানুষগুলো ঝুকিপূর্ণ জেনেও নিরুপায় হয়ে পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, হাটহাজারীর দক্ষিণ জঙ্গল পাহাড়তলী এলাকার শাহা আমানত কলোনি, কাইচ্ছাঘোনা, লেবু বাগান, জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী, আকবর শাহ কলোনি, ফতেয়াবাদের পশ্চিমে সন্দ্বীপ কলোনি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, হাটহাজারী পৌরসভার পশ্চিমে দেওয়ান নগর সন্দ্বীপ পাড়া, মির্জাপুর ইউনিয়নের সরকার হাট বাজারের পশ্চিমে, চারিয়া নয়াহাট বাজারের পশ্চিমে, কাটিরহাট এলাকার পশ্চিমে কাঞ্চনপুর এবং উদালিয়াসহ ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিমে মন্দাকিনী রেঞ্জের পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশ ঝুঁকিতে বসবাস করছেন লক্ষাধিক মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কিছু ‘পাতি নেতা’ অধিকাংশ পাহাড় দখল করে পাহাড়ের পাদদেশে কাঁচা ও সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। শুধু তা নয় ওইসব পাহাড়ে বসবাসরত অসাধু চক্রগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে একটি সিন্ডিকেট চসিকের দক্ষিণ জঙ্গল পাহাড়তলী ঠান্ডাছড়ি পিকনিক রিসোর্টের আধা কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ের মাটি কেটে বসতঘর নির্মাণ ও বিক্রি করছে। প্রতি ৪ শতক জায়গা ১ থেকে ২ লাখ টাকায় তারা দেশের নদীভাঙা হতদরিদ্র মানুষের কাছে বিক্রি করছে। সরকারি পাহাড়ের ঢালের মাটি কেটে সমান করে টিন দিয়ে তৈরি করছে বসতঘর। আইনত কোন ভিত্তি না থাকলেও সরকারি পাহাড়ের জায়গা তারা দলিলমূলে বিক্রি করছে।
এছাড়া দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডস্থ ফতেয়াবাদ ও চৌধুরী হাটের পশ্চিমে সন্দ্বীপ কলোনি এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী জামাল উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম ও শরীফা আক্তারসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, এখানে আমরা ঝুঁকিতে বসবাস করছি। নগরীর অন্যান্য স্থান থেকে বাসা ভাড়া কম হওয়ায় এখানে থাকি। এছাড়া আমরা ভূমিহীন। যাওয়ার মত কোন স্থায়ী ঠিকানা আমাদের নেই। আমাদের পূনবার্সনের জন্য কোন উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে না।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল জানান, পরিবেশ তার নিজস্ব নিয়মে চলে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরিবেশবান্ধব কাজ না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত পাহাড়ধসের মত বিপর্যয় হতেই পারে। বর্তমানে আমরা বেশ ঝুঁকিতে আছি। পাশাপাশি সরকারও বেশ কঠোর অবস্থানে আছে। তবে বর্ষার আগে আমাদের তথা সংশ্লিষ্টদের উচিত ছিল পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিগুলো সরানোর উদ্যোগ নেয়া। মনে রাখতে হবে সচেতন না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়বে না। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভূমিহীন মানুষ যারা পাহাড়ে বা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন, তাদেরকে নিতান্তই বসবাস করতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। তার বিপরীত হলে ভয়াবহ দুর্যোগে তাদেরকে পড়তে হবে। বন উজাড় করে গাছ ও পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় তার প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারায়। এছাড়া প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলেও পাহাড়ধস হতে পারে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুহুল আমিন মুঠোফোনে জানান, উপজেলার পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা হয়। এছাড়া কয়েক দিনের ভারিবর্ষণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে কাটিরহাট এলাকার পশ্চিমে ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের উদালিয়া গ্রামে সোনাই ত্রিপুরা পল্লীর পাহাড়ে বসবাসরত ১০ পরিবারকে পাশের একটি নবনির্মিত স্কুলে এনে রাখা হয়েছে। এরপরও আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে কেউ বসবাস করছেন কি না, নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ে বসবাসরত এসব মানুষকে স্থায়ী পূনর্বাসনে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে ১১ জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাস সংলগ্ন দক্ষিণ জঙ্গল পাহাড়তলীর লেবু বাগান ও কাইচ্ছাঘোনায় পাহাড়ধসে প্রায় ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে।