রাজনীতিতে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়

90

লায়ন মো. আবু ছালেহ্

একজন তৃণমূল আওয়ামী লীগের কর্মীর চরিত্রে যেমন দলের জন্য ত্যাগ তিতিক্ষা রয়েছে তেমনি তার নিরাবরণ, সহজ, সরল মন ও জীবন সবাইকে আকৃষ্ট করে। তার সরলতার জন্য সবাই তাকে ভালোবাসেন। এখন আলোচনায় মুখর কিভাবে তৃণমূলে যুক্ত আওয়ামী লীগকে একক পদপ্রার্থীর পিছনে প্রতিটি ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করবে? যেহেতু একজন তৃণমূলের কর্মী থেকে জন্ম আমার তাই তৃণমূলের একজন ওয়ার্ড সদস্যকে জিজ্ঞেস করেছি যারা মূলত দলের জন্য ত্যাগী তারা কি প্রাধান্য পাবে সম্মেলনে? তখন হাসিমুখে বলল একেকটি এলাকায় আওয়ামী লীগের অনেক শক্তিশালী সভাপতি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী রয়েছেন। জনপ্রিয়তায়ও তারা কোনো অংশে কম নন। কিন্তু সেসব ওয়ার্ডে প্রতিটি সম্মেলনে একজনকেই সিলেক্ট করা হয়। আর তাকে নির্বাচিত করে দেন। এতে বারবার পছন্দের মানুষ পদ পায় । বাকিদের আর সুযোগ হয় না। সেখানে ত্যাগী, জেলখাটা, ঝুকি নেওয়া কর্মীর কোন দাম থাকেনা। আবার দেখা যায় তাদের পরিবারের সদস্যরাও সে তকমা লাগিয়ে নেয়। ঠিক যেমনটি কোন কারণে পদ ধারীর মৃত্যু হলে দেখা যায় তার স্ত্রী বা সন্তান মনোনয়ন পান। এতে যারা দিনের পর দিন দল করেন, কষ্ট করেন, সংগঠনকে সময় দেন, মানুষের সুখে, দুঃখে পাশে থাকেন; নির্বাচন যুদ্ধে তাদেরকেই বঞ্চিত হতে হয়। পদ ধারী হলেই নেতারা নিজের, পরিবারের বা আত্মীয় স্বজনদের এমনকি বিশস্তকর্মীদের ভাগ্য বদলে দিয়ে আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মতো রাতারাতি বিত্তবৈভব ও সম্পদের মালিক হন। অনেকের পদ পাওয়ার আগে যে অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল, পদ পাওয়ার পর দেখা যায় সেটি কাটিয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির উপর তারা দাঁড়িয়ে গেছেন।
নানা মহলের এই সমালোচনা আড্ডার টেবিলে ঠাঁই পেলে রসিকতার ছলে একজন নেতা বললেন, ‘ধরেন, আপনারা যে কথা বলছেন, সেটিও যদি সত্যি হয় তাহলেও ওয়ার্ডের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক করার সময় প্রতিটি ওয়ার্ডে বিকল্প, শক্তিশালী নতুন প্রার্থীর সন্ধান করে তাকেই দেয়া উচিত। কারণ নিজের ভাগ্যবদলই যদি হয় রাজনীতি, তাহলে দল একজনকে কেন বারবার ভাগ্যবদলের সুযোগ দেবে? সকলেরই দলে শ্রম আছে। সকলেরই দলের কাছে পদ পদবী পাওয়ার অধিকার আছে। একজন বারবার সভাপতি হয়ে নিজের ভাগ্য অনেক বদলেছেন, এবার নতুন কাউকে সেই ভাগ্য বদলের সুযোগ দেয়া উচিত-এমন যুক্তিতে হলেও বিকল্প জনপ্রিয় কাউকে দেয়া যেতে পারে। আর যদি মনে করেন, বারবার দলের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক হতে গিয়ে মানুষের কল্যাণে আত্মত্যাগ করতে করতে রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে গেছেন তাহলেও তাদের আর নিঃস্ব হতে না দেয়ার জন্য হলেও পরিবর্তন আনা জরুরি। এতে একজনকে নিঃস্ব হতে হলো না। আত্মত্যাগে সবাই সুযোগ পেল। দলের প্রতি আনুগত্য রেখে পথ চলা তৃণমুল কর্মীরা সংগঠনের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেন। এখানে শুধু একটি ওয়ার্ডের কথাই বললাম। সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ওয়ার্ড এলাকায় আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ, গ্রহণযোগ্য প্রার্থী রয়েছেন; যারা বারবার দলীয় নেতৃত্বের আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন। অনেক এলাকায় সৎ, আদর্শবান নেতাকর্মী আছেন যারা দলের নেত্রী ও আদর্শের প্রতি অনুগত। কোনো সিন্ডিকেটে তাদের সম্পর্ক নেই।
বেশ কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় বলেছিলেন, এখন রাজনীতি করতে হলে ‘এম এম বি’ থাকতে হবে। অর্থাৎ মানি, মাসল এবং ব্লেসিং থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সময় ছিল ৭৫ উত্তর। সেই সময় থেকে প্রতিটি দুঃসময়ে নিরন্তর দল ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে খেয়ে না খেয়ে পথ হাঁটা অসংখ্য নেতাকর্মী পোড়খাওয়া রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নিজেদের তৈরি করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ৯০ উত্তর গণতন্ত্রের সূচনায় ১৯৯১ ও ৯৬ সালের নির্বাচনে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় ছাত্রদলের অসংখ্য নেতা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ৭৫ এর পর ও ৯০ এ ভূমিকা রাখা ছাত্রলীগের নেতারা স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে অসংখ্য পরিচিত মুখ এখনো দলীয় মনোনয়ন লাভ করতে পারেননি।
রাজনীতিতে টাকা, পেশীশক্তি ও চাটুকারিতার যে আস্ফালন দেখা দিয়েছে সেখানে আদর্শিক রাজনীতির পথ হাঁটা নেতাকর্মীরা পিছনে পরেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আরেকটি বিষয় বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ইমেজের ওপর ভর করে ৫০ বছর আগে কে নেতা হয়েছিলেন, হঠাৎ করে এত বছর ধরে তৈরি নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে তাদের সন্তানদের ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা। আরেকটি হলো কোনো এমপি, মন্ত্রী, নেতা মারা গেলে বছরের পর বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দলের নেতাকর্মীদের বুক দিয়ে আগলে রাখা সংগঠকরা সে পদ পান না। আবেগের তড়িতে তুলে আনা হয় তাদের স্ত্রী, পুত্র বা কন্যাদের। এখানে যোগ্যতার চেয়ে পরিবারতন্ত্র বড় হয়ে দেখা দেয়।
ঝুঁকি নেয়, শ্রম দেয়, জেল খাটে কর্মীরা আর মনোনীত হয় উড়ে আসা বিত্তশালী, পেশীশক্তি বা করুণাগ্রিতরা। এতে করে দলীয় নেতাদের ভাষা হাইব্রিড, কাউয়ারাই উঠে আসে। নিদারুণ অবহেলায় পরে থাকে কর্মীরা। আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ অনেক নেতা তৈরি করেছে। নিরন্তর সংগ্রাম ও সংগঠকের ভূমিকায় তারা পথ চলছেন। তাদের কতজন মনোনীত হয়েছে এ পর্যন্ত? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ। ইঙ্গিত করেছেন, নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য। জনমত জরিপে যারা এগিয়ে থাকবেন, তারাই মনোনয়ন পাবেন। বিগত ইউপি নির্বাচন ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন সর্বশেষ দলকে তৃণমূল পর্যায়ে বিভক্ত করেছে। ইউপি নির্বাচনে জেলায় জেলায় মনোনয়ন বাণিজ্য দলের ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। প্রতিটি এলাকায় আওয়ামী লীগের ৪-৫ জন করে পদ প্রত্যাশী এখন মুখোমুখি। অনেক এলাকায় প্রতিদ্ব›িদ্বতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের আদর্শিক নেতাকর্মীরাও পরে আছেন।
মিয়ানমার সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে জীবন নিয়ে পালিয়ে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীর বোঝা বহন করছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমার শাসকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে; আজীবন গণতন্ত্রের সংগ্রামী, নির্যাতিত, নিপীড়িত নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল পাওয়া অন সান সুচির সকল অর্জন রোহিঙ্গাদের রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে। ঠিক তখন গোটা বাংলাদেশ মানবতার হৃদয় নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনগুলো দিনরাত পরিশ্রম করছে তাদের সেবায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয়ই দেননি, শরনার্থী শিবির ঘুরে তাদের মমতাই জড়াননি; বিশ্ব দরবারে জনমত গড়ে তুলতে, মিয়ানমার শাসকদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ও সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। জাতিসংঘে ৫ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের জন্ম ও তার সংগ্রামে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে গোটা জাতির ঐক্যবদ্ধ লড়াই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে। একটি অসা¤প্রদায়িক, শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আদর্শ। এখানে সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষেরা স্বাধীনভাবে তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন-এটাই সাংবিধানিক অধিকার। আর আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলের মধ্যে স¤প্রীতির আত্মার বন্ধন নিয়ে পথ চলা। সেই সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির ঐতিহ্য কখনো সখনো সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মতলববাজদের কারণে হোঁচট খেয়েছে। সেটি সকলের জন্য লজ্জা ও বেদনায়। আমরা সেই লজ্জা ও বেদনার পথে হাঁটতে নারাজ। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়, ধর্মান্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে কাউকে দেখা বা বিচার করা নয়, জাতিগত অবস্থান থেকে আমরা সবাই এক রাষ্ট্রের নাগরিক। আমরা মানুষ, আমরা মানবতার পক্ষে মানবিক শক্তি। দানব শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। এক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে একটি স¤প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়ার কৃতিত্ব জাতি হিসাবে আমাদেরকেই বড় করেছে। সকল ধর্মের নাগরিকরাই তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে ধর্মীয় রীতিনীতি স্বাধীনভাবে পালন করবেন। ধর্মীয়ভাবে তাদের বিচারের জায়গা নিজস্ব সৃষ্টিকর্তার ওপর। এক ধর্মের মানুষের ওপর আরেক ধর্মের মানুষের বল প্রয়োগ সংবিধান, আইন, ধর্ম কোনটাই অনুমতি দেয় না।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিতর্কের মুখে, দুর্নীতির অভিযোগে সরকার বিরোধী সকল রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যম থেকে সিভিল সোসাইটি বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জায়গায় অনড় ছিলেন। পরিষ্কার বলেছিলেন, কোন দুর্নীতি হয়নি। কানাডার আদালতের রায় শেখ হাসিনার পক্ষে গেলে আমরা সেদিন যারা সমালোচনা মুখর হয়েছিলাম তাদের সবার মুখে চুন পরেছে। সবাই সেদিন বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়া পদ্মাসেতুর কাজ সম্ভব নয়, সেদিন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করবো। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থাকাকালীন তার মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্প্যান বসিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ পৃথিবীর সামনে দৃশ্যমান করেছেন। এটি শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রতি কোনো স্তুতিবাক্য নয়, নির্মোহ সত্যকে স্বীকার করে নেয়া। আমরা সেদিন পদ্মা সেতু চেয়েছি, আমরা উন্নয়ন চেয়েছি, চেয়েছি দেশ এগিয়ে যাক। দেশের ওপর কলংকের অভিযোগ আসায় আমরা আর্তনাদ করেছি। আমাদের আশংকা, অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। শেখ হাসিনার কথাই সত্য হয়েছে। জাতি হিসাবে আমরাই বড় হয়েছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন, দুর্নীতির কলংক থেকে আমাদের তিনি মুক্তই করেননি, পদ্মাসেতু উদ্বোধন করেছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন, আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা পারি। আমরাও মেনে নিয়েছি, আপনিই পারেন- একটি গ্রহণযোগ্য ওয়ার্ড ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সংগঠক, চট্টগ্রাম মহানগর কৃষক লীগ