রাজধানীর নাম করা হোক ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ সিটি

16

লিটন দাশ গুপ্ত

আজকের এই শিরোনামের নিবন্ধটি লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহরের ‘ল্যাসুইট’ আবাসিক হোটেলে বসে। ঐ সময় হ্যানয় শহর থেকে হো-চি-মিন সিটি যাবার কথা ভাবছিলাম। ‘হো চি মিন’ মানে সেই দেশের একজন বিপ্লবী রাজনীতিবিদ, যার নামে এই নগরী হো-চি-মীন রাখা হয়েছে। সেই ‘হো চি মিন’ সিটির নামকরণে অনুপ্রাণিত হয়ে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম পরিবর্তন করে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ করার দাবি জানাবো ভেবেছিলাম। বিভিন্ন কারণে-অকারণে দেরী হলেও আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমার দাবী উত্থাপন করতে চাই।
ভিয়েতনামে যখন গিয়েছি সেখানে দেখেছি, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর, ব্যবসা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে হো-চিন-মিন এর ছবি, মূর্তি বা ভাস্কর্য। আর সকল নাগরিক দিনের কার্যক্রম শুরু করে, ঐ ছবি বা ভাস্কর্যতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে। উল্লেখ্য রাজধানী ‘হ্যানয়’ হলেও হো-চি-মিন সিটি হচ্ছে ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ শহর। আগে এই শহরের নাম ছিল সায়গন। অবশ্য সেটিও সেই দেশের এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদের নামে ছিল। শুধু ভিয়েতনাম কেন? বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের কথা বললে যে দেশটি নাম সবার সামনে আসে, সেটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর নাম সেই দেশের জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন এর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এমন কি আমেরিকার নামটিও রাখা হয়েছে আমেরিগো ভেসপুচির নামে। এছাড়া খাজাখাস্তানের রাজধানীর নাম ‘আস্টানা’ ছিল। গত ২০১৯ সালে এই রাজধানী নাম আস্টানা’র পরিবর্তে নুর-সুলতান রাখা হল। নুর-সুলতান হচ্ছে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট। লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়া, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর নামে। নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটন, সেটিও বৃটেনের নাগরিকের নামে রাখা হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘সোয়াজিল্যান্ড’। এই পুরো রাষ্ট্রটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হল ‘ইসোয়াটিনি’। ‘পেট্রোগ্রাড’ এর নামবদল করে রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিনের নামানুসারে রাখা হল ‘লেলিনগ্রাড’। আবার দেড় হাজার বছরের বেশী সময় ধরে তুরস্কের একটি নগরীর নাম ছিল ‘কনস্ট্যান্টিনোপল’। পরবর্তীতে তুর্কিরা এই শহরের নাম রাখে ‘ইস্তাম্বুল’। এই রকম দেশ ও রাজধানীর নাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পৃথিবীর বহু দেশের বহু অঞ্চলের নাম সেই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তির নামানুসারে করা হয়েছে। যে সকল ব্যক্তির নামে নগর বা অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে, সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেই বরণীয় ব্যক্তির অবদান জাতীয়ভাবে স্বীকৃত বা কোন কোন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য ও স্মরণীয়। সেই হিসাবে দেখা যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান কেবল বাঙালি জাতির জন্যে স্মরণীয় নয়, সমগ্র বিশ্ব নেতার কাছে অনুকরণীয়। এই মহান নেতার নামের আগে-পরে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করে পরিপূর্ণ আনা সম্ভব নয়। কারণ যিনি অবিসংবাদিত বিশ্ববরেণ্য মহান নেতা, যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, যিনি স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি, যিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান।
কেবল অতি উচ্চস্তরে নিরপেক্ষভাবে সূক্ষাতিসূক্ষ সুচিন্তিত বিশ্লেষণে অনুভব করা যায়, যাঁর জন্ম না হলে আমরা এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গকিলোমিটারের স্বাধীন ভুখÐের মানচিত্র পেতাম না; যাঁর জন্ম না হলে আমরা পৃথিবীর বুকে স্বকীয়মহিমায় লাল সবুজের পতাকা উড়াতে পারতাম না; যাঁর জন্ম না হলে এপাড় বাংলার বাঙালি জাতি টাইটানিকের মত আটলান্টিক মহাসাগরে নিমজ্জিত হত; তিনিই বাংলারাষ্ট্রের সৃষ্টিকর্তা, উন্নতজাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, সকল উন্নয়নের প্রথম ¯্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কেবল বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেননি; যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে হাজারো সমস্যাগ্রস্ত ভঙ্গুর দেশকে অতি কম সময়ে দ্রæত পুনর্গঠন করে, শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছিলেন। যা বিশ্ব মানচিত্রে অন্য কোন সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, ঋণী বাঙালি জাতি কেন পারবে না হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠতম বাঙালির নামে রাজধানীর নামকরণ করে সামান্যতম ঋণ শোধ করার উদ্যোগ নিতে?
আমাদের দেশের রাজধানীর নাম ঢাকা। এই ঢাকার নাম রাখেন রাজা বল্লাল সেন; সম্ভবত দশম শতাব্দীর কোন এক সময়ে। আমরা ঢাকার নামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে, বাংলা প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী যখন ঢাকা ছিল, তখন সেই সময় এই শহরের নাম স¤্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে জাহাঙ্গীর নগর রাখা হয়। পরবর্তীতে আবার পূর্বনাম ঢাকা ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
রাজধানী হচ্ছে এমন একটি নগর বা শহর, যেখান থেকে সমগ্র রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম ঐ শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে থাকে। রাজধানী থেকে সরকার পরিচালিত হয় বলে সরকারের সকল প্রকার সভা অধিবেশন অনুষ্ঠান এখানেই সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি বৃন্দ আসে সাধারণত রাজধানীতে। দেশের আইনসভাও রাজধানী কেন্দ্রিক হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে, রাজধানীর পরিবেশটা হতে হবে, যানজট ও দূষণ মুক্ত উন্নত পরিবেশ, সুশৃঙ্খল জীবনমান সম্পন্ন ও সর্বোপরি একটি সুপরিকল্পিত নগরী। অনেক বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, ঢাকা শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভাবে। আর তা যদি হয়, তবে রাজধানী স্থানান্তরের কথা ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ ঢাকা শহর থেকে রাজধানী স্থানান্তর করে, অন্য কোন উপযুক্ত জায়গা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করে, ঐ নতুন জায়গাতে পরিকল্পিত নগর গড়ে, রাজধানী করার কথা ভাবা যেতে পারে। যা ইন্দোনেশিয়ার সরকার ইতোমধ্যে সেই দেশের রাজধানী জাকার্তা থেকে সরিয়ে বোর্নিও দ্বীপের কালিমান্তান শহরে নেবার কথা ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া মায়ানমারের (পূর্ববতী বার্মা) রাজধানী রেঙ্গুন থেকে সরিয়ে ‘নিপিডো’ শহরে আনা হয়েছে। নাইজেরিয়া সরকার সেই দেশের রাজধানী ‘লাগোম’ থেকে সরিয়ে বা স্থানান্তর করে আবুজায় এনেছে। এছাড়া পর্তুগাল, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশ তাদের রাজধানী স্থানান্তর করেছে বা করতে পেরেছে। কোন একটি দেশের রাজধানী নাম পরিবর্তন করা কিংবা অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ বিষয়, একইসাথে ব্যয়বহুলও বটে। নাম পরিবর্তন করতে হলে শহরের সাইনবোর্ড পথনির্দেশিকা সরকারি বেসরকারি নথি পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি ইত্যাদি সহজতর বিষয় নয়। আবার অন্য জায়গায় নতুনভাবে শহর সৃষ্টি করে রাজধানী গড়ে তোলা আরো কঠিনতর বিষয়। তারপরেও আমি মনে করি, যে রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ) বাঙালি জাতিকে স¦াধীন বাংলাদেশ নামে ভূখন্ড উপহার দিয়েছে; যে রাজনৈতিক সরকার বর্তমানে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে; যে সরকার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মাসেতু নির্মাণ, কর্ণফুলী নদীতে ট্যানেল তৈরীর মত বৃহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে; যে সরকার ৩৫০ নটিক্যাল মাইলের বেশী সমুদ্র জয় করতে পারে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ জয় করতে পারে, যে সরকার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে বিশ্বের বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে, সেই রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অন্য জায়গায় রাজধানী স্থানান্তর করে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ কিংবা বর্তমান রাজধানী ঢাকার নাম পরিবর্তন করে শেখ মুজিবুর রহমান সিটি করা অসম্ভব কিছু নয়। তাই এই মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর একশ একতম জন্মবার্ষিকীতে ঢাকার নাম পরিবর্তন করে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করার জন্যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয় সুদৃষ্টি কামনা করছি। একইসাথে চট্টগ্রাম ৮ আসনের জননেতা মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মোছলেম উদ্দিন আহমদ মহোদয়কে, সংসদে এই বিষয়ে বিল উত্থাপনের জন্যে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। এই ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত থাকলে প্রয়োজনে গণভোট গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক: সাহিত্যিক ও সম্পাদকÑ ত্রৈমাসিক ত্রিকাল পত্রিকা