রাঙ্গুনিয়ায় জীবন সংগ্রামী ৫ জয়ীতা

69

দারিদ্রতাকে পেছনে ফেলে একাগ্রতা ও পরিশ্রমে সফলতা পেয়েছেন রাঙ্গুনিয়ার পাঁচজন নারী। সমাজের নানা বঞ্চনা, অবহেলা, নির্যাতন প্রতিহত করে তাঁরা একন এলাকায় অনুকরণীয়। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক দপ্তরের জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি এ ৫ সফল নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। সম্মাননা পাওয়া সংগ্রামী এ ৫ নারীর জীবন কাহিনী একেক জনের আলাদা আলাদা।
শিপ্রা বড়–য়া : শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক নারীর নাম শিপ্রা বড়–য়া। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ৮নম্বর ওয়ার্ড সৈয়দবাড়ি গ্রামের শৈবাল তালুকদারের স্ত্রী শিপ্রা বড়–য়া। ৫ ভাই ৩ বোনের সংসারে দারিদ্রতার কারণে মেধাবী হওয়া স্বত্তে¡ও শিপ্রাকে এইচএসসি পড়ালেখাকালীন সময়েই বিয়ে দেয় তার মা-বাবা। তিনি চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন, বি,এড ট্রেনিং করেন এবং এম-এ পাশ করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই নিজের মেধা দিয়ে তিনি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীতে যোগদান করেন। শিপ্রা বড়–য়া চট্টগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।
মদিনা বেগম : জীবন যুদ্ধে সফল এক নারী মদিনা বেগম। উপজেলার হোছনাবাদ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড খিল মোগল গ্রামের কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাশ করেই দারিদ্রতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় তার। এরআগে ১৯৭১ সালে স¦াধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্না-বান্না, বাজার করা ও খবরাখবর সংগ্রহ করার কাজ করেছেন। ১৯৭৪ সালে রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালীতে একটি আর.ডি.পি’র মহিলা কর্মসূচিতে মহিলা পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে স¦ামীর আপত্তির মুখে চাকুরি ছাড়লে পরিবারে অভাব-অনটন ও নানান মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। সেলাই কাজ, বাঁশ-বেতের কাজ করা, জাল বোনা, কৃষি কাজ ইত্যাদি করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। পাশাপাশি সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করতে নিরলস পরিশ্রম করে যান। এর মধ্যে কাজ করেছেন বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও সংস্থায়। ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জড়িত থাকার স্বীকৃতি স্বরূপ পরপর ২ বার হোছনাবাদ ইউনিয়নে ইউপি সদস্যা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও হোছনাবাদ ইউনিয়নের প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, ব্রাক সংস্থার সহযোগীতায় ৩ টিরও অধিক ব্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে রাখেন বিশেষ অবদান। গ্রামীন পিছিয়ে পড়া ছেলে মেয়েদের স¦াবলম¦ী করতে সেলাই, বাটিক-বুটিক, কার্পেন্টার প্রশিক্ষন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
রাশেদা আকতার : রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড তিন সৌদিয়া গ্রামের আহম্মদ শুক্কুর ও আলোয়ারা বেগমের কন্যা সন্তান রাশেদা আকতার। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী এ নারী তার পিতা-মাতার ৭ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। পাহাড় থেকে লাকড়ি কাটার টাকায় সংসার চলতো তাদের। অভাব অনটনের কারণে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। সংসারের দাদ্রিতা গুছাতে তিনিও মায়ের সাথে পাহাড় থেকে লাকড়ি কাটা এবং গ্রামের ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। একসময় তিনি শেলাইয়ের কাজ শেখেন এবং টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রথমে একটি সেলাই মেশিন এবং পরবর্তীতে ৩টি মেশিন কিনে একটি সেলাইয়ের দোকান দেন। তার দোকানে সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি তিনি অন্য নারীদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করেন।
শেলী দাশ : রাঙ্গুনিয়ার পাশ্ববর্তী রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরা গ্রামের তপন দাশ ও মঞ্জু মহাজনের ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান শেলী দাশ। বিয়ের পর এখন তিনি রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড ঠাÐাছড়ি গ্রামের স্বামীর বাড়িতে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের বিপদে পাশে থাকার কারণে সবার ভালবাসায় বর্তমানে রাজানগর ইউনিয়নের ৪, ৫, ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা নির্বাচিত হন। মহিলা মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে তিনি এলাকার মহিলাদের পারিবারিক বিবাদ মিটানো সহ নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড প্রাপ্তিতে এলাকার দরিদ্র, অসহায় জনগণকে সহযোগিতা করেন। এলাকার মহিলাদেরকে আত্ম-নির্ভরশীল করার জন্য তিনি তাদেরকে উৎপাদনমুখী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণে পরামর্শ দান ও ঋণ গ্রহণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন। এছাড়াও তিনি উদ্যোগী হয়ে স্যানিটেশন সচেতনতা সৃষ্টি সহ বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, বহুবিবাহ রোধ ও যৌতুক সহ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে এলাকায় তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন।
মনজুরা বেগম : সংসার জীবনে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা সফল এক নারীর নাম মনজুরা বেগম। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড ফকিরখীল গ্রামের আহমদ মিয়া ও মাহমুদা খাতুনের সন্তান তিনি। মঞ্জুরার বিয়ে হয় ১৯৭৪ সালে। তার স্বামী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সংসার জীবনের এক পর্যায়ে তার স্বামীর জীবনে চলে আসে অন্য এক নারী। এরপর থেকেই স্বামী মনজুরাকে তালাক দেওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করে। এদিকে ছোট ৮ সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবেন সেই চিন্তাই তালাক পেপারে স্বাক্ষর না করায় স্বামী তার উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ছোট ৮ সন্তান সহ তাকে ঘর ছাড়া করেন তার স্বামী। সংসার হারা মনজুরা স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন, যেখানে তার মামলা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। একদিকে সংসারে অভাব অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ, সাথে আবার মামলার চালাতে গিয়ে একেবারে দিশেহারা অবস্থা তার। একপর্যায়ে তাকে আলোর পথ দেখালো বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড। উক্ত সংস্থার সহায়তা পেয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে তিনি গ্রাম্য কুটির শিল্পের কাজ শুরু করেন। এক সময় মামলাতেও জয়ী হন তিনি। কুটির শিল্প থেকে উপার্জিত টাকায় তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে অবশেষে সুখের জীবনের সন্ধান পান। তার মতো অসহায় ও নির্যাতীত নারীদের সাহায্য করতে গিয়ে ২০১১ সালে রাঙ্গুনিয়া পৌরসবার ১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি।