রাউজান নামের উৎপত্তি ও বিকাশ

132

মোহাম্মদ নুরুল হুদা

উত্তর চট্টগ্রামের এক কিংবদন্তি জনপদের নাম রাউজান। ১৬৬৬ সালে মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের প্রায় ১০০০ বৎসর পূর্বে এ জনপদের সৃষ্টি। কথিত আছে, সেই প্রাচীনকাল থেকে এ জনপদ বৌদ্ধদের আবাস ভূমি ছিল । সেই ১৬০০ বছর আগে রাউজানে যে জনপদ সৃষ্টি হয়েছিল, তা পরবর্তী বৃটিশ শাসনামল, পাকিস্তানি শাসনামল, এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ -সর্বক্ষেত্রে রাউজানের মাঠি, মানুষ ও কৃতি সন্তানেরা দেশের দুঃসময়ে হাল ধরেছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল। মাস্টার দা সূর্যসেন, নির্মল কুমার সেন, কবি নবীন সেন, নতুন সিনহ, ফজলুল কবির চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, আলহাজ ইউসুফ চৌধুরী, সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম, গবেষক আব্দুল হক প্রমুখ।
এ ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন। রাউজান নামক এ জনপদের উৎপত্তির ও বিকাশ স¤র্পকে আমার ছোট প্রয়াস। রাউজানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেশের দুই প্রধান নদী, খরস্রোতা কর্ণফুলী ও হালদা। এ উপজেলার উত্তরে ফটিকছড়ি, দক্ষিণে বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী নদী, পূর্বে রাঙ্গুনিয়া ও কাউখালী, পশ্চিমে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত। বাংলা একাডেমি হতে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত রাউজানের কৃতি সন্তান বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক আব্দুল হক চৌধুরী রচিত “প্রবন্ধ বিচিত্রা ইতিহাস ও সাহিত্য ” নামক গ্রন্থে রাউজান নামের উৎপত্তি সর্ম্পকে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। সেই তথ্য মতে রাউজান নামটি একটি আরাকানি শব্দ, অর্থ গোচারণ ভূমি। প্রাচীনকালে এই জনপদে আরাকানদের প্রচুর গোচারণ ভূমি ছিল। আর গোচারণ ভূমি থেকে সৃষ্টি হয় রাউজান নামটি। ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ খাঁর “আহাদিসুল খাওয়ানিন” (১৮৭০সালে প্রকাশিত) গ্রন্থের ২৯৮ পৃষ্টায় রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামের শ্রীযুক্ত রায় পরিবারের বর্ণনা প্রসঙ্গে রাউজান নামের উল্লেখ করেন। সাহিত্যিক মাহাবুবুল আলম “চট্টগ্রামের ইতিহাস- নবাবী আমল” খন্ডের ৬৮ পৃষ্টায় হামিদুল্লাহ খাঁর ‘শ্রীযুক্ত রায়’ পরিবারের ‘রায়’ থেকে ‘রায়উজান’ এবং পরবর্তীতে রাউজান নামের উৎপত্তি হয় বলে উল্লেখ করেন। আবার অনেকে মনে করেন, রাউজান নামটি হিন্দু প্রভাবিত নাম। প্রাচীনকালে নোয়াপাড়া গ্রামের ‘শ্রীযুক্ত রায়’ পরিবারটি নবাবী আমল থেকে এই জনপদে খুব প্রভাবশালী পরিবার ছিল। উক্ত পরিবারের স্মারক করনে ‘রায়উজান’ নামের উদ্ভব হয়। কালক্রমে রায়উজান নাম বিবর্তিত হয়ে রাউজান হয়।
অনেকের মতে, এই উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের একটি ছোট ধানীবিলকে এখনো ‘রোয়াঙে’ বিল বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে ‘রোয়াঙে’ থেকে রাউজান নামের সৃষ্টি হয়েছে। রাউজানের মাস্টার নিবারণ চন্দ্র বড়ুয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮০ সালে শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক পুস্তিকার ৯ পৃষ্টায় রাউজানের ইতিহাস শিরোনামে রাউজানের উৎপত্তি সর্ম্পকে লেখা হয়- ‘ প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ বর্তমান রাউজান এবং কাগতিয়া গ্রামের সংযোগস্থলে বসবাস করতো। তখন কাগতিয়া খাল মহাদেবপুর (বর্তমান মুহাম্মদপুর) এর উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল।
তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের “রাউলী” বলা হত। কোন এক মহাপ্রাণ ‘রাউলী’ রাউজান কাল কাটিয়ে কাগতিয়া খালে সংযোগ করেছিলেন। তখন এই সংযোগস্থলকে ‘জান’ বলা হত। রাউলী দুই খালের মাঝে ‘জান’ দিয়েছিলেন বলে এই খালের নাম রাউজান খাল। পরে তা রাউজান গ্রাম হয়ে রাউজান থানাতে রূপ লাভ করেন। তবে অধিকাংশ গবেষকদের মতে, খ্রিস্টিয় ৭ম ও ৮ম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা র্ধম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকান গমন করেছিলেন।
সঙ্গত কারণে রাউজানের আদি রাসিন্দা ছিলেন বৌদ্ধগণ। তারা এই জনপদকে ‘রাজোয়াং’ রাখেন। রাজোয়াং খাঁটি আরাকানি শব্দ। পরবর্তীতে রাজোয়াং শব্দটি বিকৃত হয়ে রাউজান হয়। ব্রিটিশ সিভিলিয়ন চট্টগ্রামের সেটেলমেন্ট অফিসার সি জি এইচ এলেন বলেন- Raozan the name of place means the hamlet of cows in the arakanese language.. অর্থাৎ রাউজান আরাকানি শব্দ, যার অর্থ হলো গোচারণ ভূমি। পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, রাউজান নাম করণে বৌদ্ধদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তবে যে উৎস থেকেই রাউজান নামটি আসুক না কেন, আমরা রাউজানকে ভালোবাসি, আপনজনের মত, পরম আত্নীয়ের মত, এমনকি আমাদের মায়ের মত।
লেখক: লেকচারার, ইংরেজী বিভাগ, গহিরা কলেজ