রমজানের পণ্য আমদানি সংকট দূর ও সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ জরুরি

12

আরবি সন গণনায় আর মাত্র দুই মাস পর পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। এরমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেছে। রমজানের ইফতারিসহ ভোগ্য পণ্যের যাতে সংকট না হয় সেই জন্য আমদানি খাতকে উন্মুক্ত করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন ডলার সংকটের কারণে আমদানি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। একটি জাতীয় দৈনিকে সম্প্রতি ডলার সংকট ও ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডলার সংকটে বিদেশ থেকে রমজানের ছয়টি নিত্যপণ্যের (ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজ) আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য আলাদাভাবে ডলার মজুত রাখতে ব্যবসায়ীরা স¤প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিলে এর পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপরও বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতায় নিত্যপণ্য আমদানির বিল পরিশোধে বিলম্ব ও এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে গত প্রায় তিন মাস এলসি খোলার হারও কমেছে। এ অবস্থায় আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া রমজান মাসে আদৌ ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে কিনা, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা জানি, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে রমজান সামনে রেখে ২০২২ এর ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপণ্য আমদানির এলসি খোলা। আশঙ্কার মধ্যেও আমরা আশা করতে পারি, সরকার অতীতের রমজানে আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে কঠোর ছিল। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটবে না।
অপরদিকে রমজানে চালের বাজার আবারও অস্থির করার নানা ফন্দির কথা গণমাধ্যমে আসছে। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট নামক অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী খুবই তৎপর। জানা গেছে, পদ্ধতিগত ও মূল্য জটিলতায় সাধারণ কৃষক সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে উৎসাহী হচ্ছেন না। এ সুযোগে ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগদ টাকায় ধান কিনছেন। সহজ প্রক্রিয়ায় তুলনামূলক বেশি দামে ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে ধান বিক্রি করতেই কৃষক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে চালের বাজার অস্থির হওয়ায় মিলাররা সরকারি গুদামে চালও দিতে চাচ্ছেন না। এবার দেশে রেকর্ড পরিমাণ আমন ধান উৎপাদন হয়েছে। তারপরও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের হোঁচট খাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। সরকারি গুদামে মজুত কম থাকলে খাদ্যপণ্যের বাজার কিছুদিন পরপর অস্থির হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
আমরা আশা করব, ডলারের বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণ এবং চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নেবে সরকার। তবে পণ্য সময়মতো আমদানি করে তা ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থাও সংশ্লিদের করতে হবে। মানুষ এখন আর ব্যবসায়ীদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। স¤প্রতি চিনি নিয়ে ব্যবসায়ীরা যে ধরনের কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে, তাতে মানুষের কাছে এটা আবারও স্পষ্ট হয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়াবে আর ভোক্তাদের বাড়তি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এর প্রধান কারণ সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। বস্তুত আমদানিনির্ভরতার কারণে ভোজ্যতেল, চিনি-এসব নিত্যপণ্য ক্রয় করতে গিয়ে ভোক্তাদের বাড়তি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব স্থানীয় বাজারে পড়বে, এটা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর রমজান শুরুর আগেই যখন ভোগ্যপণ্যের বাজারে বাড়তি অস্থিরতা দেখা দেয়, কর্তৃপক্ষ তখন কী করে? সার্বিক পরিস্থিতিতে এটাই স্পষ্ট-সিন্ডিকেটের তৎপরতা রোধে তদারকি সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারছে না। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে আমদানিনির্ভরতায় পণ্যের সংকট কতটা তীব্র হতে পারে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যতটা সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কাটানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে নিত্যপণ্য আমদানিতে যত ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাই প্রদান করা হোক না কেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ভোক্তারা এর সুফল পাবে না। এছাড়া সরকার ও ব্যবসায়ীদের মনে রাখা চাই, রমজান মাস ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আবেগ ও অনুভুতির মাস। এ মাসে মানুষ সংযম সাধনা করে, উপবাস শেষে একটু ভালো খাবারের প্রত্যাশা করে, সেহেরিতেও অনুরূপ প্রত্যাশা করে। কিন্তু সরকারের নীতি বা ব্যবসায়ীদের অতি মোনাফার লোভের কারণে যদি তা ব্যাঘাত ঘটে, তাতে সরকারের ভাবমুর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং এ বিষয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের সময় থাকতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।