রফিকুল আনোয়ার

204

সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা বৃক্ষের মতো। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁরা বড় হয়ে ওঠেন। এক সময় ফলবান বৃক্ষের মতোই ছায়া আর ফল দান করেন অকাতরে। রফিকুল আনোয়ার সেরকমই এক সবুজ বৃক্ষ ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানাধীন নানুপুরের ডালকাটা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আলহাজ্ব রফিকুল আনোয়ার ১৯৫২ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রতিটি কর্মপরিক্রমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তাঁর কর্মোদ্যম, মানবব্রতী মন মানব কল্যাণে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে তা যুগ যুগ ধরে মানব সমাজকে তার অভীস্ট লক্ষ্যের দিকে নিরন্তর অনুপ্রাণিত করবে। বিশেষ করে ফটিকছড়ি জনপদের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান মন্দির-মসজিদসমূহে অকাতরে তাঁর দান, জীবনাচরণ এলাকার মানুষের কাছে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়েই থাকবে। রফিকুল আনোয়ারের সেবাধর্মী বিশেষ করে শিক্ষার প্রচার-প্রসারকল্পে এলাকার ঘরে ঘরে শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্যে তাঁর যে আকাক্সক্ষা, কর্মপ্রয়াস ছিল তারও বিস্তৃত তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা শিক্ষার প্রতি, শিক্ষকের প্রতি তাঁর যে গভীর অনুরাগ ভালোবাসা ছিল, তার প্রতিফলন ঘটাতে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে দেশের মানুষকে সে মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। দেশ তথা সমাজ-উন্নতির জন্য তাঁর যে নিবেদিত মন প্রাণ ছিল তা আজ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। রফিকুল আনোয়ার ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি রাজনীতি করতেন মানুষের সেবা করার জন্য। নব্বই দশকের শুরুতে সমগ্র ফটিকছড়িতে অকাতরে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। তিনি সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেন নানুপুর লায়লা-কবির কলেজ। তাঁর স্বপ্ন ছিল এ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে এই জনপদের মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। সাবেক সংসদ সদস্য, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব রফিকুল আনোয়ার পুরো জনপদের নন্দিত জননেতা তিনি। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে গেছেন রাজনীতির ধারালো সড়কে। রাজনীতিকে তিনি সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে নিয়েছিলেন। আর মনে গেঁথেছিলেন জনগণকে অকৃত্রিম সেবা দানের অনুপম আদর্শ। আলহাজ্ব রফিকুল আনোয়ার ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপি’র দলীয় প্রার্থী, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমেদকে পরাজিত করে প্রথমে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি তৎকালীন বিএনপি প্রার্থী সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাÐারীকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো ছিল তাঁর নির্বাচিত কর্মসূচি। এক-এগারোর তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় তিনি দীর্ঘদিন কারাভোগের কারণে নির্বাচন করতে পারেননি। রফিকুল আনোয়ার ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত প্রাণত্যাগী নেতা, একনিষ্ঠ সমাজসেবক। চট্টগ্রামসহ ফটিকছড়ির উন্নয়ন এবং আধুনিক ফটিকছড়ি প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রামের শিক্ষা-ক্রীড়া-সংস্কৃতির উন্নয়নের রফিকুল আনোয়ার যে অবদান রেখে গেছেন, ফটিকছড়িসহ চট্টগ্রামবাসী তা আজীবন মনে রাখবে। তিনি গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষের বেদনাকে হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করতেন বলেই আপামর জনসাধারণের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন সহজেই। বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েও নিরহংকারী লোক ছিলেন ও অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। ফটিকছড়িতে এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির নাই, যেখানে রফিকুল আনোয়ারের অনুদান বা উন্নয়নের ছোঁয়া নাই। রফিকুল আনোয়ার দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগে অবশেষে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর সকাল ৮.৫০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ভাই, স্ত্রী, এক কন্যা, আত্মীয়স্বজনসহ অনেক গুণাগ্রাহী রেখে যান। তাঁর অকাল মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। কেননা এই সময়ের রাজনীতিতে রফিকুল আনোয়ারের মতো উদার চিত্তের নেতার বড়ই অভাব। আজকের এই দিনে তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে যে অবদান রেখে গেছেন, তা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। বর্তমানে তাঁর একমাত্র ছোট ভাই রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক ফখরুল আনোয়ার ও তাঁর একমাত্র কন্যা সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সানি ফটিকছড়ির মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য রাত দিন কাজ করে যাচ্ছেন। মরহুমের অবদান ও ত্যাগের কথা স্মরণ করে এ জনপদের জননায়ক রফিকুল আনোয়ারকে মানুষ স্মরণ করবে আজীবন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক