রফিকুর রশীদের মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত কিশোর গল্প

61

নূরনাহার নিপা

রফিকুর রশিদ। সাহিত্যাঙ্গনে জনপ্রিয় একজন শক্তিশালী লেখক। বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমরা আনন্দ উচ্ছ¡সিত। তিনি ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প,উপন্যাস, গান, প্রভৃতি শাখাতে তিনি একজন দক্ষকথাসাহিত্যিক। তিনি ছোটদের জন্য যেমন সপ্রাণ ও নিবেদিত, তেমনি বড়দের জন্য ও অনন্যসাধারণ। তিনি বর্তমান সময়ের সচল জনপ্রিয় লেখক। ছোটদের জন্য লেখা।
গল্প এবং উপন্যাসে রফিকুর রশিদ এনেছেন বিপুল বিষয় বৈচিত্র্য। তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধার কথা তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত কিশোর গল্পটিতে ১৬ টি গল্প প্রকাশিত। প্রতিটি গল্প আধুনিকতার ছোঁয়া নান্দনিক। অপূর্ব বিষয়,ভাব, কল্পনায়,শব্দ শৈলি উপমা নৈপুণ্য অসামান্য প্রশংসিত কিশোর গল্পগুলো যেমন:জন্মদিনের ছবি,সেদিন রেসকোর্স এবং, দাদির রেডিও, খুশি দিবস, বিজয় দেখার দিন, স্বাধীনতার গল্প,পালিয়ে গেছে পাকিভূত,হারুন মূধার চ্যালা,শান্তমণির আঁকাআঁকি,সৌরভের হারানো ঘুড়ি, জাতীয় পতাকার গল্প,অন্য প্রভাতফেরি, গ্রামের নাম বীরেরমাটি, জন্মদিনের গল্প, ভূতের বাড়ি হাত বাড়ানো, অন্য অস্ত্র, বিভিন্ন গল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প, তাঁর দেশের গল্প, বাড়ির গল্প, ইসকুলের গল্প অসাধারণভাবে উপমাগুলো রচিত।
মানুষের যন্ত্রণা,সংগ্রাম,হাহাকার, মানুষের অধিকার, মানবতা,দায়বদ্ধতা, সামাজিকতা,
বেদনা রক্তক্ষরণ, দেশ মাটি মানুষের স্বপ্ন আবেগ কল্পনা, জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিটি গল্পতে।নাটক, গান প্রভৃতি শাখাতেও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। ছোটোদের জন্য যেমন তিনি সপ্রাণ ও নিবেদিত; তাঁর জীবনের চরম বাস্তবতার গল্প লিপিবদ্ধ করেছেন প্রতিটি গল্পে দারুণভাবে ফুটে তুলেছেন। ছোটোদের জন্য রচিত সমস্ত রচনায় তিনি জীবনের কথাই বলেছেন, কথাসাহিত্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয় ও নির্মাণ-কৌশল অসাধারণ। তাঁর লেখায় মানবতার মানুষের অধিকারের পক্ষে সাজের বাস্তবতা দায়বদ্ধতা স্পষ্ট। কিশোর গল্পের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই।
স্বাধীনতার গল্প-স্বাধীনতা মানে কী? যা পরাধীনতা নয়,তাই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে মুক্তি স্বাধীনতা মানে সব বাধা ঠেলে সামনে এগিয়ে চলা। স্বাধীনতা মানে পাখির কাকলি,রাতের জোনাকি,স্বাধীনতা মানে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, স্বাধীনতা মানে সাগরের হাতছানি, পাহাড়ের মতো উন্নত মম শির। স্বাধীনতা গল্পে সহজ সরল বাক্যে,নিখুঁত উপমা তাঁর গল্পে জীবনের বিচিত্র্য পরিবেশ। স্বাধীনতার বর্ণনা কিছু অংশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
দাদির রেডিও – দাদির কাছে বিস্তারিত জানতে চায় রেডিও বৃত্তান্ত। নাতির দাবির কাছে পরাস্ত হয় বৃদ্ধা। কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো তার দাদু যুদ্ধের সময় ফিরে না আসার গল্প দাদির মুখে বিবরণ শুনতে শুনতে পলাশের মন হয়ে যায় নরম কাদামাটি।বুকের ভেতর থেকে গুমরে ওঠা ফোঁপানি চেপে সে শুধায়,দাদু কি আর কখনোই ফিরে আসবে না? পলাশের আব্বু সহসা চমকে ওঠে। নিজের মায়ের এবং পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে কর্তব্য স্হির করে ফ্যালে দিনের
সূচনালগ্নে। প্রগাঢ় উচ্চারণে -তিনি দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। আর কখনো ফিরবে না। গল্পটিতে দাদির অপেক্ষা তার স্বামী নিখুঁজ। যুদ্ধ শেষে ফিরবে বাড়ি সে আশাতে। স্বামীর দেয়া রেডিওটা খুব যতনে রাখে লুকিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধার খবর শুনতেন। ভাঙাচোরা রেডিওটা তাঁর সম্পদ।অসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের ঘটে যাওয়া স্মৃতি চারণ লেখক গল্পটিকে সহজ ভাবে নির্মাণ করেছেন চিত্রকল্পে।
জাতীয় পতাকার গল্প-সারা গায়ে রোদ মেখে জাতীয় পতাকা সগৌরবে ওড়ে মুক্ত বাতাসে!
সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত অনাবিল শহীদের রক্তমাখা ওই সূর্য। সূর্যের কাজ কী? আঁধার তাড়ানো, আলো ছড়ানো।বাঙালির জীবনে পরাধীনতার অন্ধকার সরিয়ে মুক্ত আলো দিয়েছে ওই সূর্য। জাতীয় পতাকার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট হবে ৬ ফুট। জাতীয় পতাকা আমাদের সম্মানের প্রতীক। এই পতাকা লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত।
জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও প্রদানের সময় সবাইকে নীরবে উঠে দাঁড়াতে হয় শ্রদ্ধা জানাতে হয়। জাতীয় পতাকার গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদের ও জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান নিঁখুতভাবে কবি রচনা করেছেন ভাষাবিন্যাসে চমৎকার।
সৌরভের হারানো ঘুড়ি- এই গল্পে স্বপ্ন, কল্পনা, উপমা, শান্তির প্রতীক, বেদনা, সৃষ্টিশীলতায় এখনো তার প্রাণশক্তি অফুরন্ত অসাধারণ।
এই গল্পটি অংকিত হয়েছে। ঘুড়ি হারিয়ে সৌরভের মনের আকাশ তবু মেঘলা। ইচ্ছা করে তার ঘুড়ির সসুতো কেটে দিল,এই ভো-কাট্টা লড়াই সে চাইনি।ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে অজান্তে কথন ভারতীয় মাটিতে পা রেখেছে, সৌরভ টের পায়নি।
হারানো ঘুড়ি নজরে পড়ে না। মুজিব নগর আমবাগানে ডুকে পড়ে, সে মুজিবকে কখন চোখে দেখেনি।সে না থাকা মানুষটির নামেই তাহলে এত আয়োজন।ভিড়ের মধ্যে মাথা গুঁজে নিজের জায়গা করে নেয়।বড় অনুষ্ঠান শপদ গ্রহন চলছে।সৌরভের হাত পা নিশপিশ করে। দু পা পিছিয়ে সে গাছের ডালে তাকায়। উঁচু গাছের ঘাড় মাথায় লটকে আছে একটি ঘুড়ি। ঘুড়ির মধ্যে শেখ মুজিব। ঘুড়ির এক কোণে নির্বাচনী প্রতীক নৌকা।এটা তারই ঘুড়ি বটে। তবু সে আর ঘুড়ি ফিরে পেতে চাই না। গাছের মাথায় থাক,তবু আছে তো এরই মাঝে। উড়ুক, ঐ ঘুড়ি শূন্যব্যাপি। কেউ না জানুক, একা সৌরভ জানবে তিনি আছে মুজিব নগরে, আর মুজিব মানেই গোটা বাংলাদেশ। ঘুড়ি হারানো বেদনাটুকু কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ফুরফুরে এক ঝলক হাওয়া দুলে ওঠে তার বুকের ভেতর।
অন্য অস্ত্র -মিলিটারি আসে কুসুমপুরে। গ্রামের শুরুতেই পরপর গোটা দশেক বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিল, রাইফেলের গুলিতে লাশ ফেলে দিল পাঁচ সাতটা,তারপর লুটপাট শুরু করে,এক সময় ছেলের সামনে মিলিটারিরা তার বাবাকে গাড়িতে নিয়ে যায়। ছেলে চিৎকার করে ডাকে আব্বু বলে কিন্তু তাদের হৃদয়ে কোন দয়া মায়া নাই। রান্নাঘরে গিয়ে তার মায়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে আরেক মিলিটারি।পরনের কাপড় এলোমেলো লুটিয়ে পড়েছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতে করতে আঁছড়ে পড়ে। মিলিটারিরা আবার ঝাপটে ধরে তাকে।তখন তার ছোট্ট ছেলেটির সাহস করে তার মাকে রক্ষা করতে চোখে এক প্রতিশোধের আগুন জ্বলে সে ছোট হলে ও বুদ্ধি করে দু হাতে ধুলোবালি ভরে নিয়ে ক্ষিপ্রহাতে ছুঁড়ে দেয় লোকদের চোখেমুখে।বিকট শব্দে চিৎকার করে লোকটি দুচোখে তার অন্ধকার। সেই সুযোগে মাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। কবি রফিকুর রশিদ অসাধারণ বেদনার উপমা গল্পটিতে চোখে বয়ে যায় অজগ্র জলের হিসাব।
অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তন্মধ্যে রয়েছে :

কিশোর গল্পগ্রন্থ :
স্বপ্নেভরা কিশোরবেলা, ইচ্ছে পুতুল, চার গোয়েন্দার কাÐ, গল্পগুলো ক্লাসের নয়, ঈদ মানেই আনন্দ, লাস্ট বেঞ্চের ছেলেটি, আকাশ আবার ফার্স্ট হবে, সৌরভের হারানো ঘুড়ি, সুতোকাটা ঘুড়ি এবং ভূতের গল্প, ভূতের বাড়ি হাত বাড়ানো, বারো রাজ্যের রূপকথা, প্রভাতফেরি, একুশের কিশোর গল্প, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প, রাসেলের জন্য ভালোবাসা, নজরুল জীবনের গল্প, রবীন্দ্র-নজরুল : ছেলেবেলার গল্প, বিজয় দেখার দিন, একাত্তরের সূর্যোদয়, বিজয় দেখার দিন, বরণীয় জীবনের স্মরণীয় গল্প, বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেল : ছেলেবেলার গল্প, মধুমতি পাড়ের খোকা, বঙ্গবন্ধু কিশোরসমগ্র। মধুমতি পাড়ের খোকা।

কিশোর উপন্যাস :
অপারেশন মুজিবনগর, কাজল ইজ এ গুড বয়, পরীবানু আবার স্কুলে যাবে, ইভানের বিয়ে, বীরের মাটি, পিন্টু বাহিনীর যুদ্ধযাত্রা, ইদিপাসের গল্প, এক যে ছিল রাজকন্যা, এক যে ছিল রাখালরাজা, ফিরে এলো রাজপুত্তুর, ভূতুড়ে ক্লাব এবং আমাদের পাইলট স্যার, ভালো ভূতের যতো কাÐ, আমাদের স্কুলে সত্যিই ভূত ছিল না।

ছড়া ও কিশোরকাব্য :
জন্মদিনের ছড়া (পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস), যুদ্ধদিনের ছড়া, ছড়ার বাড়ি কড়া নাড়ি, ভাষার লড়াই ছড়ায় ছড়ায়, মশকরানির মন্ত্রীসভায়, ছড়ার পাখি ডাকে আমায়, নূর হোসেন এক কাব্যলেখা, আকাশজোড়া মায়ের আঁচল, চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু।
প্রবন্ধ :

সাতকাহনের গদ্য, রবীন্দ্রনাথ : পত্রপুট
গবেষণা :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর, মেহেরপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কিশোর ইতিহাস, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কিশোর ইতিহাস, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি : মেহেরপুর জেলা।
সম্পাদিত গ্রন্থ :
নির্বাচিত একুশের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প, মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ কিশোর গল্প, এই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, রাসেল আমাদের ভালোবাসা, আলোকিত বঙ্গবন্ধু।

এছাড়া আছে বড়দের গল্পগ্রন্থ :
হলুদ দোয়েল, স্বপ্নের ঘরবাড়ি, দিনযাপনের দায়, এইসব জীবনযাপন, জীবনের যতো জলছবি, শেকড়ছেঁড়া মানুষের গল্প, রৌদ্রছায়ার নকশা, প্রেমের গল্প, অশনিপাতের দিন, না গৃহ না সন্ন্যাস, সাদা মেঘের পালক, দ্বিতীয় জন্মের কুহক, প্রথম কদমফুল, অন্ধকারের উৎস হতে, অন্যযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, গল্পগুলো বঙ্গবন্ধুর, গল্পসমগ্র-১, ২ ও ৩

বড়দের উপন্যাস :
হৃদয়ের একূল ওকূল, দারুচিনি দ্বীপের ভেতর, দাঁড়াবার সময়, ছায়ার পুতুল, নিষিদ্ধ সুবাস, বাড়ির নাম সংশপ্তক, খননেররাত, চার দেয়ালের ঘর, ভালবাসার জলছবি, পাপী পিয়া এবং পদ্মফুল, প্রস্তুতিপর্ব।
রফিকুর রশীদের জন্ম : ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, মেহেরপুর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ এম.এ. ডিগ্রির পর বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। দীর্ঘদিন গাংনী কলেজে অধ্যাপনা শেষে এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইতোমধ্যে পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। তন্মধ্যে রয়েছে : ফিলিপস্ গল্প লেখা পুরস্কার, এম. নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী সম্মাননা স্মারক, চন্দ্রাবতী একাডেমী শিশুসাহিত্য সম্মাননা, কাজী কাদের নেওয়াজ জন্মশতবার্ষিকী সম্মাননা, ডা. লুৎফর রহমান স্মৃতি সাহিত্য পদক, কবি সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার, বগুড়া লেখকচক্র স্বীকৃতি ও সম্মাননা, কথাসাহিত্যকেন্দ্র পদক, কাঙাল হরিনাথ পদক ও পুরস্কার, অরণি সাহিত্য পুরস্কার, অরিন্দম-চুয়াডাঙ্গা শুভেচ্ছা স্মারক, দিজেন্দ্র পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ)।
তিনি একজন সহজ সরল অসাধারণ মনের মানুষ।তিনি আমাদের সাহিত্যের সম্পদ। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার একজন যোগ্য লেখকের হাতে পৌঁছায় বলে আমাদের আনন্দ বেশি।
আপনার লেখালেখির জীবন আরও সমৃদ্ধ হোক,আমাদের সাহিত্য আরও উজ্জ্বল হোক।
আপনি সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আমাদের প্রত্যাশা।