রপ্তানীমুখী বাইসাইকেল প্রস্তুতকারী কারখানা আলিটা বাংলাদেশ

33

পূর্বদেশ ডেস্ক

১৯৯০ সালে মালয়েশিয়ায় শিল্পায়ন চলছিল দ্রুত গতিতে। ফলে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিক পাচ্ছিল না শিল্প কারখানাগুলো। বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ করতেন এমন কারখানাগুলোতে শ্রমিক সংকটই দেশের বাইসাইকেল উৎপাদন খাতের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করে।
তাইওয়ানের নাগরিক ইয়ে চেং মিনের ‘আকোকো’ নামের বাইসাইকেল তৈরির কারখানা ছিল মালয়েশিয়ায়। শিল্পায়নের প্রভাবে শ্রমিক সংকটে তিনিও বেশ বিপাকে পড়েন। তার কারখানায় কর্মরত কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। শ্রমিকরাও অভয় দেন, তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে সস্তায় শ্রম পাওয়া যাবে, আর শ্রমিকেরও সংকট হবে না। সেই থেকে শুরু।
১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়ার বাইসাইকেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আলিটা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) থেকে নিবন্ধন নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে ইয়ে চেং মিনের নতুন প্রতিষ্ঠান আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড। এরপর ১৯৯৫ সালের মার্চ মাস থেকে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করে কারখানটি। দেশে প্রথম রপ্তানীমুখী বাইসাইকেল প্রস্তুতকারী কারখানার গল্প এটি।
শুরুতে বিদেশের বাজারে দেশে তৈরি এই রপ্তানি পণ্যের মান প্রমাণ করতে বছর দেড়েক সময় লাগে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। ইউরোপে বাইসাইকেলের রপ্তানির বাজার বড় হতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানির যাত্রায় যুক্ত হতে থাকে দেশিয় প্রতিষ্ঠানও। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বাইসাইকেলও পোক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে থাকে বিশ্ব বাজারে।
আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এএইচএম ফেরদৌস বলেন, বাইসাইকেলগুলো আসলেই বাংলাদেশে তৈরি এটি বিশ্বাস করানোই প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল।
প্রথম চালানে তিন কন্টেইনারে প্রায় এক হাজার বাইসাইকেল পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। প্রস্তুতকৃত বাইসাইকেলের মান প্রমাণ করতে হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে রপ্তানি নিয়ে আর কোন সমস্যা পোহাতে হয়নি।
২০০৮ সাল থেকে বাড়তে শুরু করে রপ্তানি। আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের পর ২০০৩ সালে বাইসাইকেল উৎপাদন শুরু করে দেশিয় প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ। এরপর ২০১৪ সালে এ ধারায় যুক্ত হয় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। বর্তমানে ছয়টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানির উদ্দেশ্যে দেশে এই পণ্য উৎপাদন করে। ফলে রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাইসাইকেলের বাজারও বড় হতে থাকে। ২০০৭ সালে ৩ লাখ ৫৫ হাজার বাইসাইকেল রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের দিকে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা পৌঁছায় ১০ লাখে।
মহামারির আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় আসে ৮২.৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মহামারির বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০.৮৯ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের দশ মাসে তা ১৪০.৭১ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৭ দেশে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর বিশ্বে বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। রপ্তানিকৃত বাইসাইকেলের ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। বাকি অংশ যায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশে।
বাইসাইকেলের এই বিশাল বাজার শুরু হয়েছিল মালয়েশিয়া থেকে আসা আটজন শ্রমিকের হাত ধরে। তারা বাংলাদেশে এসে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের কারখানায় যোগ দেন। কারখানাটি শুরুর প্রায় আড়াই শতাধিক শ্রমিক তাদের হাতে প্রশিক্ষিত হন। দেশিয় অন্যান্য কারখানাগুলোও শুরু হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দিয়ে। বর্তমানে একটি বাইসাইকেল তৈরির কারখানা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরির আরো দুটি ইউনিটে মোট চার শতাধিক শ্রমিক কর্মরত রয়েছে।
কোম্পানিটি মূলত ৬০-২৮০ ডলার মূল্যের মাউন্টেনস ট্র্যাকিং বাইসাইকেল উৎপাদন করে। কারখানাটি বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার পিস বাইসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে বর্তমানে বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার পিস বাইসাইকেল উৎপাদন করছে। উৎপাদিত বাইসাইকেলের ৯৮ শতাংশ ইউরোপে রপ্তানি হয়। যার ৭০ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাজ্যে। ইউরোপের ব্র্যান্ড হালফোর্ডস, রিস সাইকেল লিমিটেড, মন্টি বাইকসের হয়ে বাইসাইকেল প্রস্তুত করে কোম্পানিটি।
আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার ৫৬৪৪ মিটার জমিতে ৪৭ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩০ ডলার বিনিয়োগ করে কারখানাটি গড়ে তোলে। বাইসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য এইস বাইসাইকেল নামে আরো দুটি কারখানা চালু করে ওই এলাকায়। এই দুটি বিনিয়োগ ছিল ৫৯ লাখ ২৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার। কারখানায় ফ্রেম, ফর্ক, হাতল, সেডেল, প্যাডেল, গ্রিপ তৈরি করা হয়।
বেপজা’র তথ্যমতে, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোম্পানিটি ১৭৮.১৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বাইসাইকেল রপ্তানি করে। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় ছিল ৪.৮৪ মিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪.৬৮৩ মিলিয়ন ডলার। তবে ২০২১ সালে আবার তা কমে দাঁড়ায় ১২.৫২ মিলিয়ন ডলারে।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক এএইচএম ফেরদৌস বলেন, করোনা মহামারিতে অর্ডার ভালো ছিল। কিন্তু মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতিতে ফ্রেইড চার্জ বাড়ায় কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। লকডাউনের কারণে কিছু শিপমেন্ট আটকা পড়ে। তাই একটু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। আমরা এখন কম মূল্যের (লোয়ার ভেল্যু) বাইসাইকেল তৈরির তেমন অর্ডার নিচ্ছি না। বেশি মূল্যের (হায়ার ভেল্যু) পণ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিচ্ছি। তাই অর্ডার ফ্লো একটু কম।