রপ্তানি আয়ে লক্ষ্য ছাড়িয়ে

139

রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। টানা চার মাস ধরে বাড়ছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ দুই হাজার ৫০ কোটি (২০.৫০ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে।
এই অংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ।
সদ্য শেষ হওয়া ডিসেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ২ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি অর্থ দেশে এসেছে
‘রপ্তানির এই বৃদ্ধি শেখ হাসিনার সরকারের আরেকটি সাফল্য’ দাবি করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক বছরে আমরা পণ্য রপ্তানি বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। নগদ আর্থিক সহায়তার পাশপাশি বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার সমাধান করেছি। রাস্তাঘাটেরও অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে।
এ সবের ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।”
“বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে সেটা শেখ হাসিনার সরকার টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার কারণেই হয়েছে। আর এ উন্নয়নের জন্যই আমাদের ভোট দিয়েছে জনগন।”
“শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। এই পাঁচ বছরে আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারব। রপ্তানিসহ ক্ষেত্রেই তার ছোঁয়া লাগবে।”
রপ্তানি আয় বাড়াতে মার্কিন ডলার-টাকার বিনিময় হার ৮৫ টাকা করার পরামর্শ দিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন করেছে। বাংলাদেশেও হয়েছে; তবে এ দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম।
তথ্য দিয়ে এই গবেষক বলেন, গত ছয় মাসে ভারতীয় মুদ্রা রূপির বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি। সে তুলনায় বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে দশমিক ১৮ শতাংশ মাত্র।
“রপ্তানি বাণিজ্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে খুব শিগগিরই ডলালের দর ৮৫ টাকায় ‘স্থির’ করে দেয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।”
তৈরি পোশাক রপ্তানির উপর ভর করেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ানো সম্ভব হয়েছে জানিয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমাদের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। আমরা এখন বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি। নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করছি আমরা।জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।”
“সার্বিকভাবে সব কিছুই আমাদের অনুকূলে। সে কারণেই বাড়ছে রপ্তানি আয়।”
অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শোনান ফারুক হাসান।
বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ২ হাজার ৪৯ কোটি ৯৭ লাখ (১৭.০৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।
এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪২শতাংশ বেশি।এই ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছরের এই ছয় মাসে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
ডিসেম্বরে ৩৪২ কোটি ৬১ লাখ ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
এই মাসে লক্ষ্য ধরা ছিল ৩৫৫ কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৩৫ কোটি ৩১ লাখ ডলার।
এ হিসাবে ডিসেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ।আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) আয় বেড়েছে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ দশমিক ৩৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৭ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারই এসেছে এখাত থেকে।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৮৬৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ শতাংশ।
উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮৪৩ কোটি ২৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নিটে লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েগছে ১১ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর উভেনে প্রায় ৬ শতাংশ।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ শতাংশের মতো। কিন্তু দ্বিতীয় মাস অগাস্টেই তা হোঁচট খায়। ওই মাসে গত বছরের অগাস্টের চেয়ে আয় কমে ১২ শতাংশ।এর পরের মাস থেকে তৈরি পোশাকসহ সামগ্রিক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ওপর বরাবরই তৈরি পোশাক পণ্যের বড় ধরনের প্রভাব থাকে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে তাদের কারখানার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা বৃদ্ধি রপ্তানি আয় বাড়াতে অবদান রেখেছে বলে মনে করেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, “অর্থবছরের শুরুটা খুব ভালো হয়েছিল।কোরবানির ঈদের কারণে কয়েকদিন কারখানা এবং রপ্তানি কার‌্যক্রম বন্ধ থাকায় অগাস্ট মাসে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল।সে ধাক্কা আমরা সামলে নিয়েছি।এখন প্রতি মাসেই রপ্তানি আয় বাড়ছে।”
অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে আয় বাড়বে আশা করে তিনি বলেন, “কারখানাগুলোর উন্নয়নে পোশাক শিল্প মালিকরা গত কয়েক বছরে অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন।কষ্টও করেছেন। ৮০ শতাংশের বেশি কারখানা উন্নত কর্মপরিবেশের (কমপ্লায়েন্স) আওতায় চলে এসেছে। এতে বায়াররাও খুশি।”
“খুশির খবর হচ্ছে আমরা এখন অনেক বেশি দামের পোশাকও রপ্তানি করছি।আমরা ক্রেতাদের পছন্দ এবং ডিজাইনের পণ্য দিতে পারছি।
আমাদের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ছে।”
তবে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার ব্যাপক দরপতন করায় বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।
“যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তাতে আমেরিকার বাজারে চীনের পোশাক রপ্তানি কমে যাবে। সেই বাজার বাংলাদেশের দখল করার সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়বে।”
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫১ কোটি ৬৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।
তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে রপ্তানি আয় ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ কমেছে। এ খাতে আয় দাঁড়িয়েছে ৫৩ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
একইভাবে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি আয়ও কমেছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৪২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ কম।
গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ৮২ লাখ (৩৬.৬৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। এরমধ্যে ৩০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
অর্থাৎ মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশই এসেছিল এই খাত থেকেই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সার্বিক রপ্তানি ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বাড়লেও তা ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ২২ শতাংশ কম। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে ৩৯ বিলিয়ন (তিন হাজার ৯০০ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।
এবার দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার আসবে বলে ধরা হয়েছে, যা মোট রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।