রক্তের দামে কেনা বর্ণমালা অ আ ক খ

157

চৌধুরী মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম

৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের মানুষের মোহ ভাঙ্গতে এক বছরও সময় লাগেনি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে বারোশ মাইল দুরত্ব , খাদ্য ,পোশাক, রুচি ও মানসিকতার পার্থক্য দিন দিন স্পষ্ট হতে থাকে। বাঙালিদের ঘাড়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে সে দুরত্ব ঘুচাতে মরিয়া হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি নেতারা ইংরেজি ও আরবীকে মানতে রাজি কিন্তু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি কোনভাবে মানতে রাজি নয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রয়ারি করাচিতে গণরিষদের অধিবেশনে সদস্যদের বলা হল উর্দু অথবা ইংরেজিতে বক্তব্য দিতে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেস দলের ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। এরমধ্যে সরকারিভাবে আরবী অথবা ইংরেজিতে বাংলা লেখার একুশটি কেন্দ্রও চালু হয়ে গেল। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লার মত ধর্মপ্রাণ বঙ্ভাগষাবিদ ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সহ অনেকে বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদ জানান। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করেন,পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, বাঙালিদের আরবী অথবা ইংরেজি হরফে বাংলা লিখতে হবে। ভাষা ছিনতাইয়ের এ ঘোষণা বাঙালিদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করার প্রতিবাদে ৪ ফেব্রয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ঢাকা শহরে ধর্মঘটের প্রভাব গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানেও পড়ে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবিতে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। আন্দোলন দমিয়ে দিতে ২০ ফেব্রয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একমাসের জন্য ১৪৪ ধরা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করেও বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ ,প্রতিবাদের মাধ্যমে আন্দোলনের লেলিহান শিখা ধীরে ধীরে দাবানলে রূপ নেওয়ার চিত্র দেখে পাকিস্তানিদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আন্দোলন দমাতে সব ধরনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা নিষ্ঠুর নীতি গ্রহণ করে। সব বাধাকে উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ২১ ফেব্রয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় গাজীউল হক , হাবিবুর রহমান,মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান,এম আর আকতার মুকুল, আবদুল মোমিন, আনোয়ারুল হক সহ অনেকে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সকালে আন্দোলনে যাওয়ার সময় গ্রেফতার শংকায় গাজীউল হক সহ অনেকে রাত তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাজির হয়ে যান। ভোরের আলো ফুটতেই রক্তের ফুলকিতে ভাষার অধিকার আদায়ে রক্তাক্ত আন্দোলন শুর হয়ে যায়। সূর্যের হলদে আলোর সাথে প্রতিবাদীদের পদাচরণা বেড়ে আমতল হয়ে উঠে একখÐ আন্দোলন ভূমি। দুপুর বারটার দিকে সমাবেশের ১৪৪ ধারা ভাঙার কথা উচ্চারিত হতেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে আকাশ বাতাস। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ,লাঠিচার্জ করে আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালায় ।
শহীদ হন রফিক,সালাম, বরকত সহ আরো অনেকে। রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি প্রমাণ করে জোর করে কারো ভাষা কেড়ে নেওয়া যায়না।বাঙালি জাতি যে ভাষা রক্ষায় জীবন বিসর্জন দিয়েছে তা বিশ্বে বিরল এক সংগ্রাম। রক্তের দামে কেনা ভাষার মর্যাদা রক্ষা, চর্চা বৃদ্ধি ও বিকৃতি রোধ করা সকলের দায়িত্ব।

লেখক : সাংবাদিক