রইসুল হক বাহার সুজন কুমার বিশ্বাস

3

 

দ্য ডেইলি পিপলস্ ভিউ। এক সময়ে চট্টগ্রামের সারা জাগানো ইংরেজি পত্রিকা। শেখর দাদা, হাফিজ ভাই ও আমি ‘সিটি ওয়াচ’ পেইজের কাজ করতাম। তাঁরা দু’জনই ইংরেজিতে পারদর্শী। পেইজ গেট-আপের পরামর্শদাতা শেখর দাদা। তাঁর নির্দেশে নিউজগুলোর মান অনুসারে পেইজে সেট করা হতো। একদিন শেখর দাদা পারিবারিক কাজে ছুটিতে ছিলেন। এদিকে হাফিজ ভাই শুধু নিউজগুলো তৈরি ও সম্পাদনা করতেন। ফলে পেইজ মেকিংয়ের দায়ভার আমার উপর পড়ল। তখন আমি প্রিন্ট মিডিয়ার নতুন শিক্ষার্থী। আমার যতটুকু জ্ঞান-ধারণা, সেটুকু মতে পেইজমেকিং করে টেবিলে জমা দিলাম। কিছুক্ষণ পর অফিস সহায়ক এসে বললেন, পেইজ-৩ আপনি করেছেন? আমি বললাম হ্যাঁ। আপনাকে বাহার স্যার ডাকছেন। এ কথা শুনেই বুকের মধ্যে ধুপ-ধুপ শুরু হয়ে গেল। ভাবতে লাগলাম আজ বকাঝকা কি শুনতে হয়, বিধি মালুম। ভয়ে-ভয়ে তাঁর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সালাম দিলাম। তিনি বললেন-পেইজ আপনি করেছেন? হ্যাঁ। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। গুড। পেইজ সুন্দর হয়েছে। তখন ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেই দিন ছিল রইসুল হক বাহারের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা কম-বেশি সংবাদ পাড়ার সবাই জানেন। তিনি একজন গুণী মানুষ। তাঁর সাথে যতদিন কাজ করেছি- দেখেছি তিনি পরশ্রীকাতরতায় নয়, পরহিতৈষণায় মগ্ন ছিলেন। কলিগদের সাথে ভাব ধরতেন না; তিনি সবসময় কাজ নিয়ে ভাবতেন। তাঁর হাসি অনেক সুন্দর। হাঁটার স্টাইল, কথা বলার ভঙ্গি, হেয়ার কাটিং, চেহারার গঠন ও আচরণ সবই ছিল অসাধারণ। তাঁকে কখনও উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি। তিনি সব সময় পরিমিত কথা বলতেন। কলিগদের সাথে বিনয় ও সুন্দর ব্যবহার করতেন। অফিসের পদমর্যাদা বা কাজের ক্ষেত্রে কাউকে ছোট করে দেখতেন না। তিনি কোন ব্যক্তির সমালোচনা না করে বরং ভালো দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর কাজ-কর্ম ছিল পরিকল্পিত। কোন বিষয়ে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতেন। যার ফলে কোন কাজকে বার বার করতে হতো না। নিজের কাজের প্রতি সিনসিয়র ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নিজেকে পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বীয় জ্ঞান এবং কাজের মাধ্যমে। সুন্দর কাজই যোগ্যতা প্রমাণের অন্যতম উপায় বলে তিনি মনে করতেন। কারো সাথে তোয়াজ-তোষণ করতে দেখিনি তাঁকে। তিনি অফিসে আসতেন জাস্ট টাইমে। অনেক সময় ১০/১৫ মিনিট আগে আসতেন। তাঁর সমস্ত কাজ-কর্ম ছিল সিস্টেমের মধ্যে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। বন্দরের চাকরির পাশাপাশি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় উচ্চপদে সুনামের সাথে কাজ করে গেছেন। একজন আদর্শ সাংবাদিকের গুণাবলী এবং ভালো সহকর্মী বলতে যা বুঝায়; তা সবই তাঁর মাঝে ছিল। তাছাড়া যাঁরা একসাথে কাজ করেছেন তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। রইসুল হক বাহারের বড় পরিচয় হলো- তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ভারতের হাফলং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নগরীর কৈবল্যধাম রেল স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার অভিযানে নেতৃত্ব দেন তিনি। আমার যা মনে হয়- তিনি অর্থ উপার্জনের চেয়ে জ্ঞানার্জনকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। তাই সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও সংবাদ পত্রে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশাটি তাঁর কাছে নেশার মতোই ছিল। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক সেবক পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক পূর্বকোণ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রামের ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপলস ভিউ এবং জাতীয় দৈনিক ডেইলি সান, ডেইলি স্টার পত্রিকায় উচ্চপদে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক পূর্বকোণের সহযোগী সম্পাদক ও ফুলকি স্কুলের নির্বাহী সচিব ছিলেন। রইসুল হক বাহার ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দর’ বই ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের প্রকাশনা ‘স্মরণিকা’ সম্পাদনা করেন। প্রিয়জিৎ দেব সরকার রচিত ‘পশ্চিম পাকিস্তানের শেষ রাজা’ বইয়ের অনুবাদ করেন তিনি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা ছিল তাঁর। তাছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ছোটদের জন্য ইংরেজিতে একটি বই রচনা করেন। প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী রইসুল হক বাহার ১৯৫২ সালের ১ এপ্রিল নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার চরকাকড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন বিধায় তিনি ‘বন্দরের বাহার’ নামে মিডিয়া পাড়ায় পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে পত্রিকা জগতে রইসুল হক বাহারের মত কর্মবীর, ঋজু ও আদর্শ সংবাদকর্মীর খুবই অভাব। তিনি কর্মজীবনে যে নীতি-আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। মৃত্যুদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা এবং স্রষ্টার কাছে তাঁর আত্মার সদ্গতি কামনা করছি।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী