যৌন সহিংসতার ঘটনা প্রকাশে যেভাবে মূল্য দিতে হয় নারীদের

51

ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করলে কি একজন নারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে? সত্যিটা হলো, কিছু ভুক্তভোগী বিচার পেলেও অনেকেই এরকম ঘটনা প্রকাশ করার জন্য পরে দুঃখপ্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক ধর্ষণের বিষয়ে সচেতনতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিনেমার প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেইন বা অভিনেতা বিল কসবির মত হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর এই বিষয়টি আলোচনায় আসে।
স্পেনের উল্ফ প্যাক গণধর্ষণ বা ভারতের গণধর্ষণের ঘটনার মত কুখ্যাত কয়েকটি ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী হ্যাশট্যাগ ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয় হলিউডে হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর থেকে। নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে ‘দ্য রেপিস্ট ইজ ইউ’ এর মত গানও দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়। কিন্তু শুধু সচেতনতাই যথেষ্ট নয়। ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।
আর এখন পর্যন্ত যত সংখ্যক নারী ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ধর্ষণের অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি বলে বলছে ধর্ষণ বিরোধী ক্যাম্পেইনাররা। শুধু যুক্তরাজ্যেই ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া আইনি সফলতা ২০১৯ সালে ছিল গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে পুলিশের কাছে আসা প্রতি ১০০টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মাত্র তিনটিতে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে। বলা যায়, ১০ বছর আগে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে একজন ধর্ষককে আদালতের দ্বারা দোষী সাব্যস্ত করার সম্ভাবানা এখনকার চেয়ে বেশি ছিল।
সাইপ্রাসের আইনি প্রক্রিয়ার বেড়াজালে প্রায় ছয় মাস আটকে থাকার পর এই সপ্তাহে এক বিপর্যস্ত ব্রিটিশ কিশোরী দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। সাইপ্রাসের বিচার ব্যবস্থা, ধিক তোমাকে! হয়ে ওঠে সাইপ্রাসের আদালতের বাইরে নারী অধিকার বিষয়ক অ্যাক্টিভিস্টদের বিক্ষোভের স্লোগান।
ধর্ষণ হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ আনার দায়ে ঐ কিশোরীকে কারাদন্ড দেয়ায় কিশোরীটির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন বিক্ষোভকারীরা। ২০১৯ সালে জুলাইয়ে শুরু হয় মামলাটি। কিশোরীটি পুলিশকে জানায় যে তিনি যখন এক ব্যক্তির সাথে সম্মতির সাপেক্ষে যৌনমিলনরত ছিলেন, তখন ঐ ব্যক্তির ১২ জন বন্ধু- যারা সবাই ইসরায়েলের নাগরিক- জোরপূর্বক ঐ ঘরে প্রবেশ করে এবং কিশোরীটিকে ধর্ষণ করে।
অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু অভিযুক্ত কিশোরীটিকে কোনো আইনজীবীর উপস্থিতি ছাড়াই কয়েক ঘন্টা ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ চালায়, এবং পরবর্তীতে কিশোরীটি তার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।
১২ জন ইসরায়েলিকে মুক্তি দিয়ে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হলেও কিশোরীটিকে কারাগারে পাঠানো হয়। তার মা দাবি করেন যে তার মেয়ে একটি অপরাধের ভুক্তভোগী থেকে ধর্ষণের গল্প বানানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। তার মা বলেন, মিথ্যা বিবৃতি দেয়ার জন্য তাকে চাপ দেয়া হয়। সে আমাকে বলেছে যে পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সে সম্পূর্ণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল।
কিশোরীর আইনজীবী লুইস পাওয়ার বলেন, তারা তাকে বলে যে নতুন স্বীকারোক্তিতে যদি সে স্বাক্ষর না করে তাহলে তার বন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরি করা হবে। আর সে যদি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সে তখন শুধুমাত্র ছাড়া পাওয়ার কথাই চিন্তা করছিল।
তাকে প্রায় সাড়ে চার সপ্তাহ একটি কারাগারের সেলে আটজন নারী কয়েদির সাথে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাকে বেশ কঠোর শর্তে জামিন দেয়া হয়। কিশোরীটিকে বর্তমানে নিজ দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হলেও তার পুলিশ রেকর্ডে একটি অভিযোগ রয়েছে।
কিশোরীটির অভিযোগ, সাইপ্রাসের পুলিশ তাকে বলতে বাধ্য করেছে যে সে শুরুতে মিথ্যা অভিযোগ করেছিল। সাইপ্রাসের পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিশোরীটির আইনজীবী জানান, যে তারা এই মামলা নিয়ে ইউরোপিয়ান মানবাধিকার আদালতে যাওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ভারত, সাইপ্রাস বা যুক্তরাজ্যের যেখানেই একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটুক না কেন, তার প্রভাব বিশ্বের সব জায়গার নারীদের ওপর পড়ে। ধর্ষণ সংঘটনকারীর চেয়ে পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ যেন ভুক্তভোগীর দোষ ত্রূটি খুঁজতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান রেইপ ক্রাইসিস এর মুখপাত্র কেটি রাসেল বলেন ভুক্তভোগী বিচার পাক বা না পাক, তার সাথে যেভাবে ব্যবহার করা হয় তা বিশ্বের সব জায়গায় নারীদের মনোবল ভেঙে দেয়।
এই ঘটনাগুলোর মূলে রয়েছে পুরুষ প্রাধান্য ও নারী বিদ্বেষমূলক মনোভাব। নারীদের একটি বার্তা দেয়া যে, পুরুষের চাহিদার সাথে তুলনায় তারা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই ধরনের নৃশংসতার ঘটনাও যে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে- এই বিষয়টি ভুক্তভোগীদের ঘটনা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে পারে। সাইপ্রাস থেকে ভুক্তভোগী কিশোরীটি ফিরে আসার পর থেকে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া অন্যান্য নারীরাও মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সোফি (আসল নাম নয়) জানান সাইপ্রাসে যৌন সহিংসতার শিকার হলেও ভয় ও সংশয়ে সেসময় ঐ ঘটনা প্রকাশ করেননি। সোফি বলেন, আমি যখন সেখানে ছিলাম তখন একেবারেই নিরাপদ বোধ করিনি। সেখানকার সংস্কৃতিটাই অনেকটা এমন যে, পুরুষরা আমার দেহের ওপর অধিকার রাখে বলে তাদের ভাবভঙ্গিতে আমার মনে হচ্ছিল। পুরুষরা আপনাকে ছোঁবে এবং এই ঘটনার নজরদারির কোনো পদ্ধতি সেখানে নেই।
সোফি জানান, সমুদ্রসৈকতের একটি পার্টিতে এক ব্যক্তি তার পানীয়তে মাদক মিশিয়ে দেয়। আমার জ্ঞান আসছে ও যাচ্ছে, এমন অবস্থায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। পরে আমি জানতে পারি যে আমাকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে। সোফি জানান, তিনি ঐ ঘটনা জানানোর চেষ্টা করলেও সে বিষয়ে কোনো সমর্থনই পাননি।
প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হলো, প্রত্যেক সংস্কৃতিতে আইন অনুযায়ী সম্মতির ধারণাটা ভিন্নভাবে দেখা হয়। যুক্তরাজ্যের মত কিছু দেশে, কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে পারে না বা সম্মতি প্রদান করতে অসমর্থ- এমন মানুষের সাথে যৌন মিলন করা ধর্ষণ। সুইডেনে ২০১৮ সালের একটি আইনে বলা হয় যে নিষ্ক্রিয় থাকা যৌনমিলনে সম্মতির ল²ণ নয়। কিন্তু অনেক দেশেই আইন এরকম নয়। কেটি রাসেল বলেন, আমার যদি পরিস্থিতির উন্নতি চাই, তাহলে শুধু আইন প্রণয়ন করাই যথেষ্ট নয়। সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি।
ইসরায়েলের অ্যাসেসিয়েশন ফর রেপ ক্রাইসিস সেন্টারের প্রধান ওরিত সুলিতজেয়ানু ব্রিটিশ কিশোরীর ধর্ষণ মালার বিচারের জন্য সাইপ্রাস গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ধর্ষণ সংঘটনকারীদের নির্দোষ প্রমাণ করার বাধাধরা সনাতন মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। ধর্ষণ হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তোলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা অবিশ্বাস্য।
এই রায় প্রাচীন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ও ধর্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতার বিষয়টি সামনে আনে। বিচারককে অবশ্যই বুঝতে হবে যে যৌন হয়রানির ভুক্তভোগী কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়।
একেবারেই কম বয়সী একজন নারী, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, ভবিষ্যতে চাকরি করবে, তার নামে একটি অপরাধের মামলা দেয়া হলো। এটি তার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করবে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের রেপ ক্রাইসিস সেন্টারের মুখপাত্র কেটি রাসেল বলেন, অসহানুভূতিশীল পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যাওয়া যে শুধু অসহনীয় তাই নয়, কোনো কোনো ভুক্তভোগী এক পর্যায়ে মনে করেন যে তারাই আসলে ধর্ষণের জন্য দায়ী। আর এগুলো ছাড়াও অনেকসময়ই ভুক্তভোগী ও তার পরিবার সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র কটুক্তির শিকার হয়। অনেক সময় প্রতিশোধের জন্য তৈরি করা হয়রানিমূলক ভিডিও নিয়েও ভুগতে হয় তাদের।
সাইপ্রাসে ব্রিটিশ কিশোরীটির সাথে হওয়া যৌন সহিংসতার কয়েকঘন্টার মধ্যেই ঐ কিশোরীর সাথে একাধিক পুরুষের যৌন মিলনের ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। এরকম ঘটনা ঘটেছে আরো অনেক ক্ষেত্রেই।
ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ যে করা হয় না, তা নয়। কিন্তু সেরকম ঘটনা খুবই বিরল। ধারণা করা হয় যে সেরকম মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় মোট ধর্ষণের ঘটনার এক শতাংশের ক্ষেত্রে।