যোদ্ধার বিকল্প কবি এবং অস্ত্রের বিকল্প কবিতা

109

“স্বপ্ন দেখি পৃথিবী তার মানচিত্রের চেয়েও বড়।” এমন সার্বজনীন কবিতার রচয়িতা স্বপ্নচারী কবির নাম মাহমুদ দারবিশ (৩১ মার্চ ১৯৪১ – ০৯ আগষ্ট ২০০৮)। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ আরব বিশ্ব তো বটেই, সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের এক অপরিহার্য পাঠ্য। প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় তাঁর লেখাগ্রন্থ অনুবাদ হয়ে বিশ্বব্যাপী পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সেকুলার মতাদর্শী কবি মাহমুদ দারবিশ ছিলেন ইহুদিবাদী ইসরায়েলের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তাঁর কবিতার প্রত্যেকটি শব্দ দখলদার ইসরায়েলের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেছে। অনুপ্রাণিত করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামী ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের। মূলত তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিলো অস্ত্রের বিকল্প, আর তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধার বিকল্প।
৩১ মার্চ ১৯৪১ সালে অধিকৃত ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া আরব বিশ্বের জনপ্রিয় সাম্যবাদী কবি মাহমুদ দারবিশের প্রতিটি প্রতিবাদী শব্দ ঘৃণিত ইসরাইলকে পরমাণুর চেয়ে শক্ত আঘাত করেছে। তাঁর শব্দমালা স্বাধীনতাসংগ্রামী ফিলিস্তিনিদের জাগরণের মন্ত্রে দিক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। কবি মাহমুদ দারবিশকে এজন্য তিনবার জেল এবং অনেকবার অবরুদ্ধ গৃহবন্দি হতে হয়েছে। তিনি ১৯৪৮ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে আরব-ইসরাইলযুদ্ধে গৃহহীন হয়ে নিজের জন্মভূমিতে পরাধীনতার তিক্ত স্বাদ অনুভব করা শুরু করেন। পরাধীনতার পিঞ্জর ভাঙতে শব্দ নিয়ে নিত্য খেলেছেন একজন স্বপ্নচারী দক্ষ শব্দবাজের মতো। ১৯৫৩ সালে মাত্র বার বছর বয়সে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাবাষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে তিনি তাঁর কাব্য প্রতিভার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন। কবিতাটির ভাববস্তু ছিলো আবেগ, জিজ্ঞাসা আর আক্ষেপের বিস্ফোরণ। ইসরায়েলি ইহুদি শিশুর অবাধ স্বাধীনতা আর ফিলিস্তিনি মুসলিম শিশুর সংকোচিত অধিকার মাহমুদ দারবিশের কিশোর চেতনায় ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করেছে। পরাধীন কিশোর মনের শত প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে কবিতায়,-
“হে বন্ধু
তুমি তোমার খেয়াল খুশিমতো দিনের বেলায় খেলতে পারো
তুমি তোমার খেলনা বানাতে পারো,
তোমার যা কিছু আছে, আমার তার কিছুই নেই
তোমার বাড়ি আছে, আমার নেই,
আমি উদ্ধাস্তুু ……।
আমরা কেন একসাথে খেলতেও পারব না?”
মাত্র বার বছর বয়সী পরাধীন এক কিশোর কবির এমন করুণ আর্তি যে কোন মানবতাবাদীর হৃদয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করতে বাধ্য।
কবি মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিন বা আরব ভূখন্ডেই শুধু নন, পৃথিবীর দেশে দেশে তাঁর দখলদার বিরোধী কবিতাগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা যেন অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিকল্প অস্ত্র! একজন আরব সমালোচক মাহমুদ দারবিশের কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, “মাহমুদ দারবিশের কবিতা যদি অস্ত্রের বিকল্প হয়ে না উঠতো, তাইলে এতটা সামনে তিনি আসতে পারতেন না।” ফিলিস্তিনি স্বাধীকার আন্দোলনে তিনি নিজের কলমকে অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ইসরায়েলি দমন-পীড়নে নিজের দেশের দুরাবস্থা, জনগণের দুর্দশা এবং নিজের মাতৃভূমি বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়ার বিষয়ে লিখেছেন,
“ভদ্র লোকেরা, আপনারা আমাদের দেশকে
পরিণত করেছেন কবরে
বুলেটের চাষ করেছেন আমাদের মাথায়
এবং সম্পন্ন করেছেন গণহত্যা।”
মাহমুদ দারবিশের অভিনব কর্মকৌশল গ্রামে গ্রামে আসর বসিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস “আছমিয়া” (সন্ধ্যা কবিতাপাঠ) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করেছিলো। “আছমিয়া”র জাগরণে ভীত ইহুদিবাদী ইসরাইল সরকার সন্ধ্যা হতে পরের দিন সকাল পর্যন্ত কবি মাহমুদ দারবিশকে গৃহবন্দি করে রাখতো। ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি কবি নজরুলের মতো ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশও বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণের কবি। সম্ভবত এই দু’জন কবির চেয়ে কঠোরও ক্রিয়াশীল ভাষায় পৃথিবীর অন্য কোন কবি শব্দের চাষ করতে পারেননি। মাহমুদ দারবিশের কবিতায় প্রতিটি শব্দ হতে নির্গত অদৃশ্য বারুদের তীব্র ঘ্রাণ নির্যাতনকারীর হৃৎপিÐ অসুস্থ করে তুলে। তাঁর কবিতায় শব্দে শব্দে দারুণ শৈল্পিক কারুকাজের মাধ্যমে প্রেমও রক্তরাঙা প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়,
“মেঘকে শুধায় নারী : আমার প্রিয়কে তুমিই ঢেকে রেখো
আমার পোশাক যে সিক্ত তার রক্তে।”
প্রতিবাদী শব্দের চাষ করার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেন কবি মাহমুদ দারবিশ। তিনি কবিতায় শব্দের নিঁখুত চয়ন ও বচনে অসাধারণ পান্ডিত্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দেশপ্রেমমূলক কাব্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এমনভাবে ফুটে ওঠে, যেন তিনি নিজে বা তাঁর কবিতাই ফিলিস্তিন,-
“আমি শিখে নিয়েছি সকল শব্দ আর ভেঙে সাজাতে
শুধু একটি শব্দ তৈরীর জন্য-মাতৃভূমি।”
প্রত্যেক কাজের সুনির্দিষ্ট সময় থাকে। সময়কে ধারণ করতে না পারলে কোন ফুলে পরাগায়ন হয় না, কোন নারীও গর্ভবতী হয় না। সাহসী শব্দ সৈনিক মাহমুদ দারবিশ তাঁর জনগণকে সূবর্ণ সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্ত¡কভাবে অংশ নেবার উদাত্ত আহব্বান জানিয়ে লিখেছেন,-
“হ্যাঁ, এখনই সময় দলিল-দস্তাবেজের জন্য উপযুক্ত শব্দ নির্মাণ করার
এখনই সময় দেশ আর বুলবুলির জন্য ভালবাসা প্রমাণ করার
এই বয়সে অস্ত্রকে পরিণত করতে হবে বাজনার যন্ত্রে।”
ভাবা যায়, কী বিপ্লবাত্মক কথা! “এই বয়সে অস্ত্রকে পরিণত করতে হবে বাজনার যন্ত্রে”র মাধ্যমে তিনি তারুণ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, তা আর কয়জন কবিই-বা পারে!
এটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, জুলুম -নির্যাতন যত বেশি প্রকট হয় আধিকার আদায়ের সংগ্রাম তত বেশি বেগবান হয়। মজলুম মানবতার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে, বিস্ফোরিত জনশক্তি যে কোন ক্ষমতাবানের জন্য অনিবার্য ধ্বংশ ডেকে নিয়ে আসে। একজন কল্পিত কারারক্ষীর সাথে কথোপকথনে কারাগারের লৌহকপাট হতে স্বাধীনতা আসবে বুঝিয়ে মাহমুদ দারবিশের লিখেছেন,
“সেই শিকল থেকে যা দিয়ে তুমি আমায় বেঁধেছিলে গতরাতে।”
সমাজতান্ত্রীক মূলমন্ত্রে দিক্ষিত কবি মাহমুদ দারবিশ মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতেন। কিন্তু মানবাধিকার হরণকারীদের জন্য তাঁর কোন সহানুভূতি নেই। সর্বোচ্চ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে কবি মাহমুদ দারবিশ মানবাধিকার হরণকারী ইসরায়েলি দখলদারদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন,-
“মানুষকে আমি ঘৃণা করি না
কিন্তু ক্ষুধার্ত হলে
জবর দখলকারীর মাংসই হবে আমার খাবার।”
১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরীকারী কবি মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত হলেও সমগ্র আরব বিশ্বে তিনি একজন অবিসংবাদিত কবি। “পরিচয়পত্র” কবিতায় কবি লিখেছেন,-
“শুনে রাখ
আমি একজন আরব
আমার পরিচয় পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আট সন্তানের জনক আমি
এবং নবম সন্তান আসছে পরের গ্রীষ্মে
তোমার কি হিংসে হচ্ছে?”
কবি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং দুই স্ত্রীর সাথেই পরে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। উভয় সংসারে কবি মাহমুদ দারবিশের কোন সন্তান নেই। রূপকের ব্যবহারে তৎকালীন আটটি স্বাধীন আরব রাষ্ট্রকে আরবের আট সন্তান এবং ফিলিস্তিনকে নবম সন্তান আখ্যায়িত করেছেন।
কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতায় ইতিহাস – ঐতিহ্য বর্ণিত হয়েছে সাবলিলভাবে। বৈমাত্রীয় ভাইদের সাথে হযরত ইউসুফ (আ.) এর শৈশবকালের ঘটনার কাব্যিক বিবরণ দিয়ে লিখেছেন,-
“প্রবাহিত মৃদুমন্দ হাওয়া যখন আমার
চুলে দোলা দিয়ে যায়
তখন ওরা ঈর্ষায় কাতরায়।”
শুধু আত্মকেন্দ্রীক চিন্তা- চেতনায় কখনো আবদ্ধ ছিলেন না কবি মাহমুদ দারবিশ। নিজস্ব ক্ষুরধার চিন্তা শক্তি ও উদার মানসিকতা কবিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তিনি শুধু ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি নন। তিনি বিশ্ববাসীর কবি, আপমর মুক্তিকামী জনতার প্রাণের কবি। তাবৎ মানবসভ্যতাকে নিয়ে অসাধারণ স্বপ্ন বুনেছেন কবি মাহমুদ দারবিশ,-
কী বিচিত্র এবং উদার স্বপ্ন দেখুন! অথচ পৃথিবীর দু’পায়া প্রাণিগুলো কতই না স্বার্থপর!
এটি চিরন্তন সত্য যে, যতোই সমৃদ্ধ অনুবাদ হোক না কেন, অনুবাদ কখনও মূল সাহিত্যের ভাব বা রস প্রকাশ করতে পারে না। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার অনুবাদ কোনক্রমেই বাংলা বিদ্রোহীর সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করতে পারবে না। মাহমুদ দারবিশের কবিতার শক্তি ফিলিস্তিনি জাতিকে যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ করে তোলে, সেখান হতেই বুঝে নিতে হবে তাঁর কলমের তেজ কতো শক্তিশালী ও ধারালো। কবি মাহমুদ দারবিশ ০৯ আগষ্ট ২০০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্বার্থকতার সাথে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন কবি তাঁর শক্তিশালী অস্ত্র কলমের মাধ্যমে কিভাবে নিজের পরিচয়, মাতৃভূমি, দেশ ও জাতির পরিচয়, হারানো শৈশব নিঁখুত অঙ্কনের পাশাপাশি কলম দিয়ে শব্দ তৈরি করে সে শব্দগুলো জোড়া দিয়ে যুদ্ধ করে।