যে যার বৃত্তে

34

রোকন রেজা

জগদীশের দুই চোখে তীব্র আলো এসে লাগলো। তিন ব্যাটারীর টর্চ। চোখ ধাঁধিয়ে গেলো।
এতো রাতে কারও থাকবার কথা নয়। জগদীশের গণনায় কি তাহলে কিছু ভুল হলো! নিকষ অন্ধকার ভেদ করে একটা পরিচিত কর্কশ কন্ঠস্বর, ‘জগদীশ দাঁড়া!’
জগদীশ স্থবির হয়ে গেলো নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো। নড়বার শক্তি হারিয়ে ফেললো। জগলু কাছে এলো। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো জগদীশের গালে। তারপর জগদীশের ভিমরি খাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, কবে যাবি ?
‘মঙ্গলবার।’
‘আমার এখন কি করতি ইচ্ছা করচে জানিস!’
জগদীশ চুপ।
‘ইচ্ছা করচে তোরে শাবল দি মাটির নিচি পুতে দি। শালা কুত্তার বাইচ্চা। দুধ কলা দিয়ে এতদিন…..রাগে জগলুর সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।’
‘তোরে কালকেরতি যেন আর ত্রিসীমানায় না দেখি!’
এই ঘন অন্ধকারেও জগদীশ টের পেল প্রচন্ড রাগে জগলুর চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
জগদীশ এ যাত্রা বেঁচে গেলো। সে ছাড়া পেয়ে রাতজাগা হ্যাংলা কুকুরের মতো ঘোঁতঘোঁত করে জগলুর গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো।
সে যখন লম্বা পায়ে তেঁতুল গাছটার কাছে এসে পৌঁছালো তখন গাছের মাথায় কিছু রাতজাগা পাখি খসখস আওয়াজ করে উঠলো।
জগদীশ ভয় পেলো না। এ শব্দ তার পরিচিত। অন্যরাতেও পরিশ্রান্ত হয়ে যখন সে গাছটার কাছে ফিরে আসে তখনও পাখিগুলো এভাবেই খসখস আওয়াজ করে ওঠে।
আজ কেমন যেনো অবসাদে মনটা ভারী হয়ে উঠলো তার। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লো সে। মিচমিচে নিঃশব্দ অন্ধকারে গা জুড়ানো ফিনফিনে একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল তখন। কী যে ভাল লাগছিল! ইচ্ছে করছিলো এখানেই রাতটা পার করে দেয়!
জগদীশের কাকারা সেই কবেই চলে গেছে। জগদীশদের ব্যবসা বড়। বড়দা রামাশিষ তিন মাস আগেই পার হয়েছে। ওখানে সে মুদি ব্যবসা শুরু করেছে। জগদীশের বাবা কৃষ্ণনাথ খুবই ভরসা করেন রামাশিষের ওপর। হিসেবী ছেলে। আস্তে আস্তে রামাশিষ সেখানে গুছিয়ে নিচ্ছে।
আর এখানে জগদীশ। জগদীশের বৌ-মেয়ে, জগদীশের বাবা কৃষ্ণনাথ আর মা শর্মিলী।
কৃষ্ণনাথের এখানে বড় মুদি ব্যবসা। সঙ্গে ভূষি-মালের আড়ত। আগে রামাশিষই সব সামলাতো। এখন জগদীশ। চারিদিকে টাকা ছড়ানো। গোছাতে সময় লেগে যাচ্ছে।
কৃষ্ণনাথের জমিজমা আগেই কিছু বিক্রি হয়ে গেছে। সে এখানে একটা একটা করে জমি বিক্রি করে আর রামাশিষের কাছে টাকা পাঠায়। রামাশিষ ওখানে জগদীশের একটা ব্যবস্থা করে দেবে। কৃষ্ণনাথ বুদ্ধিমান মানুষ। ওখানে গিয়ে আরও অনেকের মতো পথে বসতে চায় না।
জগলুর বাপ আজিজুল বারীও তীক্ষèবুদ্ধির মানুষ। সে ঠিকই বুঝেছে কৃষ্ণনাথ খুব তাড়াতাড়িই চলে যাবে। তাই আগে ভাগেই সে হাত করে নেয় কৃষ্ণনাথকে তার বাড়িটার জন্য। আগে জমিজমাও কিছু কিনেছে সে। কৃষ্ণনাথের বাড়িটা তার খুবই প্রয়োজন। ওটা ভেঙে মার্কেট বানাবে। টাকার তো কমতি নেই। সে ধাপে ধাপে কৃষ্ণনাথকে টাকা দেয় আর কৃষ্ণনাথ ধাপে ধাপে পাচার করে।
আজিজুল বারীর রড-সিমেন্টের বড় দোকান। সকাল সাতটার মধ্যেই দোকানে চলে আসে। তারপর জগলু ঘন্টাখানিক বাদে সকালের খাবার নিয়ে আসে। আর দুপুরে দোকানের ছটকু বাড়ি থেকে খেয়ে দু’জনেরই খাবার নিয়ে যায়। একা বাড়িতে জয়া, জয়ার মেয়ে আর জয়ার ভাবী। জগলুর বৌ পারুল। জগলুর মা বছর দুয়েক গত হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই জগলুদের বাড়িতে জগদীশদের অবাধ যাতায়াত। পাশাপাশি বাড়ি। হিন্দু-মুসলমান। কিন্তু সেটা কখনও মনে হয়নি কারও। বরঞ্চ বিপদে-আপদে আজিজুল বারী ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণনাথের জন্য।
জগলুর একমাত্র বোন জয়া। অসম্ভব রূপবতী। জগদীশ ভেবে পায়না কবে কবে এতো রূপ ওর দেহে লেপ্টে গেলো। সে এটাও ভেবে পায় না এরকম লাবণ্যময়ী সুন্দরী বউকে ঐ শালা কেন ডিভোর্স দিলো! ওর মত বোকাপাঠা এ পৃথিবীতে আর কে আছে!
জয়ার মেয়ের বয়স তিন। ওকে নিয়েই জয়ার পৃথিবী। কিন্তু পঁচিশ বছরের ডিভোর্সী নারীর এক পৃথিবীতে চলে না। আরও একটা পৃথিবী লাগে। আর সেই পৃথিবী হচ্ছে ছোটবেলার খেলার সাথী বাড়ির পাশের জগদীশ।
এই জগদীশের সাথে কতো স্মৃতি তার। জীবনের অনেকটা সময় সে ওর সাথে কাটিয়েছে। শৈশব। কৈশোর।
জয়া মাঝে মাঝে কাঠফাঁটা দুপুরে জগদীশকে তার পুরোনো বাইক নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে। জগদীশের এখন ঘাড় অবধি বড় বড় লম্বা চুল। ছোট ছোট খোঁচা দাড়ি। হাতে কাপড়ের রঙিন ব্রেসলেট। জয়ার মনে হয় ছেলেটা এখন দিনে দিনে কেমন যেনো নিরাসক্ত, উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই অপার্থিব উদাসীনতায় যেনো সবুজ ফেনিল সমুদ্রের মতো জয়াকে আকর্ষণ করে।
জয়ার মেয়েটা জগদীশের গা ঘেঁষা। মামা মামা করে পাগল করে দেয়। আপন মামাও এতো আপন হয় না।
জগদীশ বাজার থেকে ইগলু আইসক্রীম, ক্যাটবেরি চকলেট, জিরো চিপস বিনা পয়সায় নিয়ে আসে। আরো নিয়ে আসে জয়ার জন্য রঙিন কসমেটিকস। আর ঠিক এভাবেই জগদীশ একদিন বুদ্ধি করে কসমেটিকসের ব্যাগের মধ্যে নরম ফোমের দামী একটা ব্রা ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু কি আশ্চর্য! জয়া রাগ করে না। রাতে ফোন করে বলে, জগদীশ তুমি সঠিক মাপটা জানলে কি করে!
আহ! এভাবেই শুরু। জয়ার নতুন পৃথিবী।
জয়াদের পুরোনো আমলের লম্বালম্বি চুন-সুড়কির বাড়ি। পলেস্তরা খসা দেয়াল। আজিজুল বারী ভেঙে-চুরে আর কিছুই করেননি।
বিয়ের পর থেকেই জয়া পিছনের দিকটার ঘরটায় থাকে। ঘরটার শেষ মাথায় কিছু ঝোপ-ঝাড়। একটা সবেদা গাছ। দু’টো জবা ফুলের গাছ। আর একটা কাঁঠালীচাপা। কাঁঠালীচাপার পাশ দিয়ে পিছনের মাটির পায়ে চলা পথ।
মোবাইলে আগেই সংকেত চলে আসে। জয়া গ্রিন সিগন্যাল দিলে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে আসে জগদীশ। তারপর পিছনের দরজাটা আস্তে করে খুলে দেয় জয়া। জগদীশের পরিচিত পথ। তাই গাঢ় অন্ধকারে কিংবা বাজপড়া তুমুল বৃষ্টির রাতেও এ পথ মাড়াতে তার কষ্ট হয় না।
এখন রাতে আজিজুল বারীর ঠিকমত ঘুম হয় না। শরীরের নানারকম যন্ত্রণা। হয়তো বা মনেরও। বিছানায় অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে সে ঘুমাবার জন্য। কিন্তু ঘুম ধরা দেয় না। অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। বাইরে আসে। জয়ার ঘরের মধ্যে কেমন যেনো অদ্ভুত ছায়া দেখতে পায়। অতি সাবধানে জয়ার ঘরের ঝুলেপড়া ভাঙা জানালার কাছাকাছি চলে আসে। তারপর আর কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না। এমনকি কন্ঠস্বরও চিনে ফেলে। গরম লোহায় ছ্যাঁকা খাবার মতো তীব্র যন্ত্রণায় হাত দু’টো নিসপিস করতে থাকে তার।
কিন্তু কিছুই করে না আজিজুল বারী। চোরের মতো আস্তে আস্তে ফিরে আসে নিজের ঘরের রোয়াকে। সামনে পাতা কাঠের বেঞ্চিটাতে থপ করে বসে পড়ে। মাথার মধ্যে যেনো বন বন করে ইলেকট্রিক পাখা ঘুরতে থাকে। চিন্তা থমকে দাঁড়ায়।
আগামী সপ্তাহে কৃষ্ণনাথের বাড়িটা তার নামে রেজিস্ট্রি হবার কথা আছে। এখন ঝামেলা বাঁধালে সব ওলট-পালট হয়ে যাবে। মহা লসে পড়ে যাবে সে। তাছাড়া মেয়েরও একটা সরস দুর্নাম রটে যেতে পারে!
এদিকে কাজ শেষে জগদীশ যখন বেরিয়ে যায় তখন দূরের রোয়াকে এক ভৌতিক ছায়ামূর্তিকে অনুভব করে। বুকের মধ্যে ধক করে এক পলক বাতাস বিঁধে যায়। বুড়ো কি প্রতিরাতেই এখানে বসে থাকে! কে জানে!
এই গভীর মধ্যরাতে প্রশান্তি এনে দেয়া তেঁতুল গাছটার নিচে শুয়ে শুয়ে জগদীশ বুঝতে পারে কেন জগলু আজ তিন ব্যাটারীর টর্চ ফেলে তার চোখ ধাঁধিয়ে দিলো।
আজই ওদের বাড়িটা আজিজুল বারীর নামে রেজিস্ট্রি হয়েছে।