যে দেশে নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না

5

পূর্বদেশ ডেস্ক

সোমালিয়ার নতুন এমপিরা শপথ নিয়েছেন বৃহস্পতিবার; জটিল এক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত সদস্যরা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট পার্লামেন্টে বসতে যাচ্ছেন, যার একটি অংশ হাউজ অব পিপল এবং অন্যটি হচ্ছে সেনেট। কিন্তু সোমালিয়ার নাগরিকরা বেশিরভাগ দেশের মত সরাসরি ভোটে অংশ নেননি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত ভারতে ৬০ কোটির বেশি নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকে। চার মাসের বেশি সময় ধরে চলে সেখানে ভোট উৎসব।
সোমালিয়ার চিত্রটি পুরোপুরি আলাদা। বিবিসি জানিয়েছে, এক কোটি ৬৩ লাখ জনসংখ্যার দেশে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচনে ভোট দেন মাত্র কয়েক হাজার মানুষ। এর কারণ, সোমালিয়া একটি জটিল ও পরোক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিচালিত এবং সেখানে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে না। সেদেশে ‘একজন নাগরিকের একটি ভোট’ নিয়মেও নির্বাচন হয় না।
সেখানে ২৭৫ সদস্যের হাউজ অব পিপলে এমপিদের নির্বাচিত করেন আঞ্চলিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বাছাই করা সুশীল সমাজের এবং দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর বয়োঃজ্যেষ্ঠদের মনোনীত প্রতিনিধিরা। এরপর নির্বাচিত এমপিরা একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন, যিনি দেশকে নেতৃত্ব দেন। পার্লামেন্টের আরেকটি অংশ, সেনেট ৫৪ জন সেনেটর নিয়ে গঠিত, যারা সোমালিয়ার পাঁচটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তারাও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ভোট দেন।
কেন এভাবে এমপি নির্বাচন করা হয়?
নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া থেকে সোমালিয়ায় গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য বোঝা যায়। এসব গোষ্ঠী সেখানকার সমাজের মূল কাঠামো, যেখানে পশ্চিমা ঢঙের গণতন্ত্র শেকড় গড়তে পারেনি।
বিবিসির ভাষ্যে, একটি কার্যকর রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপস্থিতিও পূরণ করে আসছে এই গোষ্ঠী প্রথা। ১৯৯১ সালে সৈয়দ বারির সমাজতান্ত্রিক শাসন ভেঙে পড়ার পর থেকে এভাবেই পরিচালিত হয়ে আসছে দেশটি।
সোমালিয়ার গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তীব্র দ্ব›দ্ব বিরাজমান, যেখানে ‘ক্ষমতা ভাগাভাগি’র ফর্মুলা মেনে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি কাজ করছে। সেদেশের পার্লামেন্টে প্রধান চার গোষ্ঠীর সমান সংখ্যক আসন রয়েছে এবং বাকি গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে অর্ধেক আসন দেওয়া হয়েছে।
এই জটিল ব্যবস্থার কারণে সোমালিয়ার গোষ্ঠী প্রতিনিধিরা রাজনীতির ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠেছেন। পার্লামেন্টের দুই কক্ষ হাউজ অব পিপল ও সেনেটের নির্বাচন শেষে রবিবার প্রায় ৩০০ এমপি শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ৩০ জন এমপির বাছাই এখনও শেষ হয়নি বিভিন্ন জটিলতার কারণে, যার মধ্যে প্রার্থিতার যোগ্যতার বিষয়টিও রয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন, বিপুল দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের মধ্যেই নির্বাচন হয়েছে। ধারণা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিনিধিদের সমর্থন কিনতে লাখ লাখ ডলার খরচ করা হয়েছে।
সোমালিয়ার জন্য দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান সেদেশে নেই। বিবিসির দাবি অনুযায়ী, সোমালিয়ার রাজনীতিতে কাতারের বড় প্রভাব রয়েছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ২০১৭ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহামেদ আবদুল্লাহি ফারমাজোর জয়ের পেছনে এককভাবে অর্থয়ন করেছে দোহা। আর সে কারণে তার প্রশাসনে কাতারের ব্যাপক প্রভাবও রয়েছে। খবর বিডিনিউজের
নতুন এমপিদের অগ্রাধিকার কী হবে?
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফারমাজোর মেয়াদ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হওয়ার কারণে পার্লামেন্টের সামনে সবচেয়ে বড় কাজটি হল নতুন একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা। ফারমোজা এখনও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতিতে দেরি হওয়ার কারণে। ফলে জনগণের অনুমোদন ছাড়াই এক বছরের বেশি সময় তিনি ও আইনপ্রণেতারা ক্ষমতা ভোগ করে চলেছেন।
বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দাতাদের চাপে পার্লামেন্ট নির্বাচন শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবজ্ঞা করায় যুক্তরাষ্ট্র সোমালি কর্মকর্তাদের জন্য ভিসা-নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) হুঁশিয়ারি দিয়েছ, মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সোমালিয়ায় নির্বাচন না হলে তারা আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে।
সোমালিয়ায় নতুন সরকার গঠন করার পর, চলমান খরাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তাদের। সেখানে গত তিন বছর ধরে খরা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং দাতা সংস্থাগুলো একটি দুর্ভিক্ষের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। সেদেশে ৩৫ লাখের বেশি মানুষের খাদ্য সহায়তা দরকার এবং ১৪ লাখ শিশু দারুন অপুষ্টিতে ভুগছে।

সোমালিয়ায় পশ্চিমাদের কী স্বার্থ?
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমালিয়া নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে বড় উদ্বগের কারণ সেখানে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বেড়ে যাওয়া। আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠন আল-শাবাবের সদরদপ্তর সোমালিয়ায়, যে গোষ্ঠীকে আফ্রিকায় সবচেয়ে বিপদজনক গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রায় দুই দশক আগে সোমালিয়ার ক্ষমতা থেকে ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টসকে (ইউআইসি) সরাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইথিওপিয়ার সেনারা রাজধানী মোগাদিসুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেদেশে জঙ্গি তৎপরতা বাড়তে শুরু করে।
ইউআইসির পরাজয় আল-শাবাবকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, যেহেতু জঙ্গিরা ‘দখলদার’দের বিতারিত করার অঙ্গীকার করেছিল। বর্তমানে সোমালিয়ার অনেক অংশ আল-শাবাবের নিয়ন্ত্রণে, এবং তারা নিয়মিতভাবে সরকার উৎখাত করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আক্রমণ পরিচালনা করে আসছে।
২০১২ থেকে ২০১৬ সালের নির্বাচনগুলোকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়ে আল-শাবাব বিভিন্ন গোষ্ঠীর জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিন্দা জানায় এবং তাদের হুমকি দেয়, এমনকী কয়েকজনকে অপহরণও করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্বাচন নিয়ে তাদের ওই তীব্র প্রতিক্রিয়া কমে এসেছে। তবে তাতে উদ্বেগ কমেনি। অনেকের আশঙ্কা, এই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য ও সমর্থকরা হয়তো গোপনে পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাটিকে ভেতর থেকে ধসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
২০২০ সালে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ্যেই বলেন প্রতিবেশি জিবুতির প্রেসিডেন্ট ওমর গুয়েলেহ। তিনি বলেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে যে আমরা হয়ত শেষ পর্যন্ত এমন একটি পার্লামেন্ট পাব (সোমালিয়ায়) যার নিয়ন্ত্রণ পরোক্ষভাবে আল-শাবাবের হাতে থাকবে, কারণ তারা কিছু এমপির সমর্থন কিনে নেবে’।
কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, সোমালিয়ার পার্লামেন্টে আল-শাবাবের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আশঙ্কা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট গুয়েলেহ হয়ত বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে তারা সোমালিয়ায় একটি বড় শক্তি।
বিবিসি লিখেছে সোমালিয়ার ক্ষমাসীন গোষ্ঠী অনেক দিন আগে কথা দিয়েছিল, এ বছর তারা নিজেদের দেশে ‘একজন নাগরিকের একটি ভোট’ ব্যবস্থার প্রচলন ঘটাবে, কিন্তু তারা সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। নাগরিকদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দরকারি শর্তগুলো এখনও সেখানে পূরণ হয়নি, যেমন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের স্বীকৃতি দেওয়া-ইত্যাদি।
পরের সরকারের কাছে এ বিষয়গুলো কতোখানি অগ্রাধিকার পাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ এরইমধ্যে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে তাদের জন্য।