যে জালে আগুন জ্বলে

29

এম এ হোসাইন

সাগরে মাছ ধরে সংসার চলে জেলেদের। নিম্ন আয়ের জেলেদের একমাত্র আয়ের পথ মাছ ধরা। অনেক জেলের সম্বল বলতে আছে শুধু মাছ ধরার জাল। সে জাল দিয়েই চলে সংসারের চাকা। যখন মাছ ধরার উপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় তখন নিরুপায় হয়ে পড়েন জেলেরা। সরকারিভাবে সহায়তা দেয়া হলেও সেটা তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ সময়েও সাগরে নামেন কিছু জেলে। মৎস্য কর্মকর্তাদের তদারকিতে ধরা পড়লে মাছ ও জাল দুটোই খোয়াতে হয় তাদের। আইন অমান্যের অপরাধে পোড়ানো হয় জাল। আহরিত মাছের ঠিকানা হয় এতিমখানা।
সাগরে ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়ে মৎস্য বিভাগের নিবিড় তদারকি থাকার কথা। কোনো জেলে যাতে মাছ ধরতে সাগরে না নামে সেজন্য তাদের সচেতন করা এবং সাগরে নামার ক্ষেত্রে প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেয়ার কথা মৎস্য বিভাগের। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। মাঝে মাঝে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করে দায় সারছে মৎস্য বিভাগ। আর এসব অভিযানে যেসব জেলেকে সাগরে পাওয়া যাচ্ছে তাদের হয়তো জাল পোড়ানো হচ্ছে অথবা জরিমানা করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরতে সাগরে নামলে জেলের জাল পুড়িয়ে দিচ্ছেন মৎস্যবিভাগের কর্মকর্তারা। তবে নিরুপায় হয়ে সাগরে নামা জেলেদের জাল পুড়িয়ে দেয়াকে নির্মমতা হিসাবে দেখছেন অনেকে। কর্মকর্তাদের সঠিক তদারকি থাকলে অসহায় জেলেরা সাগরে নামতে পারার কথা নয়। তদারকির ঘাটতি থাকার সুযোগে জেলেরা সাগরে জাল নিয়ে নামছেন। আর অভিযানকারী দলের চোখে পড়লে আয়ের একমাত্র অবলম্বন সেই জাল নিজের চোখের সামনে পোড়ানো হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাট্টলী জেলেপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, সরকারি সহায়তা কিছুই পাইনি। শুনেছি ২০ কেজি করে চাল দিবে। আমার ৭ সদস্যের পরিবারে ২০ কেজি চাল দিয়ে কি হবে? আমরা জীবিকার তাগিদে সাগরে নামি। এই জালই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। জাল পুড়িয়ে দেয়া মানে আমাদের কপাল পুড়িয়ে দেয়া। আমাদের বিকল্প আয়ের কোনো পথ নেই। সরকার আমাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে কোনো জেলে নিষিদ্ধ সময়ে সাগরে নামবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারজানা লাভলী বলেন, আমরা প্রতিদিন মাছ ধরার জাল আটক করছি, পুড়িয়ে দিচ্ছি। শুধু ইলিশ মাছ নয়, এখন সাগরে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ। মাছ ধরা নিষিদ্ধের এই সময়ে আমাদের প্রতিরোধক সব প্রস্তুতি আছে। আমাদের লোকজন পাহারা দিচ্ছে। যার কারণে এসব ধরা পড়ছে। আমাদের অল্প লোকবল, পুরো সাগর পাহারা দেয়া সম্ভব না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইন তো সবাইকে মানতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষ বলে তাদের জন্য ভিন্ন কিছু তো করার সুযোগ নেই। তারা (জেলেরা) কিন্তু আইন জানে, ভালোভাবেই জানে। আইন জেনেই তারা অসাধু উপায়ে মাছ ধরতে নামছে। সরকারিভাবে তাদের প্রণোদনারও ব্যবস্থা আছে। তারপরও তারা অবৈধ উপায়ে সাগরে মাছ ধরতে নামলে আমাদের ব্যবস্থা নিতেই হয়।
সম্প্রতি আনোয়ারা থেকে ১৩ হাজার গজ জাল জব্দ করেছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা। এসব জাল পুড়িয়ে দেয়া হয়। উদ্ধার করা হয় ৩০ কেজি ইলিশ মাছ। সে অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. রাশিদুল হক বলেন, আমরা তিনটি অভিযান এবং দুইটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। এরমধ্যে ১৩টি জাল আটক করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৩০ কেজি ইলিশ মাছ জব্দ করা হয়েছে। একজনকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রণোদনা হিসেবে উপজেলার ২৪শ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেয়া হবে।
তিনি বলেন, জেলেরা সাগরে নামে বলেই আমাদের অভিযান চালাতে হয়। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হয়। এগুলোই আমাদের তদারকি। নিষিদ্ধ জাল পেলে সেগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়। জেলেদের জাল একমাত্র সম্বল ঠিক কিন্তু সাগরের মাছও আমাদের রক্ষা করতে হবে।
উল্লেখ্য, গত ৪ অক্টোবর থেকে আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সাগরে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। প্রতিবছর আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে-পরে মিলিয়ে মোট ১৫ থেকে ১৭ দিন হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার আসল সময়। এসময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নদীতে ছুটে আসে। এই সময়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময় ইলিশকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই সরকার দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।