যুদ্ধে গড়া পদ্য ছড়া

296

শিশুসাহিত্যিক কেশব জিপসী কিছুদিন নীরব থাকার পর বিগত কয়েক বছর যাবৎ লেখালেখিতে আবার সক্রীয় হয়ে উঠেছেন। গানের জগতে পর্দাপন, সঙ্গীত সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষ জড়িয়ে থাকা, গানের প্রশিক্ষক হিসেবে ব্যস্ততাসহ নানা কারণে শিশুসাহিত্যে তাঁর এই ছেদ সম্পর্কে কম-বেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু ছড়ার বীজ তাঁর রক্তের সাথে মিশে ছিল সবসময়। ছড়া লিখতে না পারার যন্ত্রনা তাঁকে কষ্ট দিত সেটা বুঝেছি তাঁর সাথে ঘনিষ্টতার কারনে। এই যন্ত্রনা লাঘবে আবার তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিগত ৪/৫ বছর ধরে।
কেশব জিপসীর প্রথম ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ‘স্বপ্নে বোনা মানিক সোনা ’ নামের বইটি ছিল তাঁর কাছে স্বপ্নের মত। বইটি প্রকাশ করে ঢাকার স্বনামধন্য প্রকাশনী আদিগন্ত। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘রঙে রঙে বোনা ’ ‘যুদ্ধে গড়া পদ্য ছড়া’ ‘খুশির সীমা নাই ও ‘কথার ভেলা গানের মেলা’।
কেশব জিপসীর ২০১৮ সালে প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ‘যুদ্ধে গড়া পদ্য ছড়া’ নিয়ে দুচার কথা বলার জন্য এত কথার অবতাড়না। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বদেশ এসব বিষয় নিয়ে ২২ টি ছড়া কবিতায় ‘যুদ্ধে গড়া পদ্য ছড়া’ প্রকাশিত হয় শৈলী প্রকাশন থেকে।
তোমার নামে গাইছে দেখো হাজার কন্ঠে গান
তোমার নামে ফুল ফুটছে ছড়াতে সুঘ্রাণ।
তোমার নামে লিখছে কবি কাব্য অন্তহীন
তোমার নামে বুদ্ধিজীবী বই লেখে রাতদিন।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যত ছড়া কবিতা-গদ্য লেখা হয়েছে তত লেখা পৃথিবীর অন্য কোন নেতাকে নিয়ে লেখা হয়েছে কি না জানা নেই। সেই নেতাকে নিয়ে কেশব জিপসীর ছড়া ‘তোমার নামে’। এ ছড়ায় লেখক নানা ব্যঞ্জনায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর তুলনা শুধু বঙ্গবন্ধু, এ কথা বাঙালি জাতি ছাড়া আর কে জানবে ? এ ধ্রæব সত্য লেখকের ছড়ায় সহজ সাবলীন ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে।
ঠোঁটের কোনে বাঁশি নিয়ে বাজাত সব সুর
কিশোর খোকার জীবন ছিল আনন্দে ভরপুর।
ছবির মত গ্রামটিতে সে ঘুরতো সারাবেলা
পুকুরজলে কাটত সাঁতার করত মাঠে খেলা।
…………………………………………..
পালাও পালাও মা বোনেরা ছেলে বুড়ো ভাই
শত্রæসেনার গুলির মুখে বাঁচার উপায় নাই্
সেই সে কিশোর দৌঁড়ে গেল অনেক দূরের পথ
ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র কাঁধে করল সে শপথ।
(মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে)
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে নাম না জানা অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ। যুদ্ধ করেছে কিশোর, যুবক, সাধারণ মানষ। যৌবনে পৌঁছার আগেই অনেক কিশোর যুদ্ধে গিয়ে তাদের সাহসী ভুমিকার স্বাক্ষর রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে তেমনি এক কিশোরের বীরত্ব গাঁথা ফুটে উঠেছে এ ছড়ায়।
আমি যখন একলা পথে চলি
স্মৃতি কেটে পেছন ফিরে চাই ,
সব বাঙালি দেখি মিলে সাথে
করছে মিছিল সন্ধ্যা সকাল রাতে ,
পাতলে দু’কান স্লোগান শুনতে পাই।
…………………………………
অবশেষে বিজয় দিবস আসে
সূর্য ওঠে, ফেটে মুখের হাসি
লক্ষ জীবন দানের বিনিময়ে
বীর বাঙালি জাগল স্বাধীন হয়ে
গাইল, মাগো তোমায় ভালোবাসি
(ফোটে সুখের হাসি)।
যুদ্ধের ভয়াবহতা বাঙালি হারে হারে বুঝতে পেরেছে। সেই ভয়াবহতার চিত্র যখনই মানস পটে ভেসে ওঠে, চমকে উঠতে হয়। এমন হিং¯্রতা প্রত্যক্ষ করেও দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি ছিল আপোসহীন। আর তাই স্বাধীনতার পতাকা হাতে বাঙালি গেয়ে ওঠে ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ’। এ লেখায় বাঙালি জাতির মুক্তির সুর প্রতিফলিত হয়েছে ছন্দে ছন্দে।
মুজিব মানে একটি দেশের জন্মদাতা পিতা মুজিব মানে সব পরাধীন জনগনের মিতা।
মুজিব মানে স্বপ্নচারী আশার ফেরিওলা মুজিব মানে বজ্রকন্ঠে দেশের কথাবলা।
……………………………….
মুজিব মানে বিশ্ববুকে স্বাধীন মাতৃভূমি মুজিব মানে বাংলাদেশের জাতির পিতা তুমি।
(মুজিব মানে)
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটি আর একটি ভালোবাসার পংক্তিমালা। এ পংক্তিমালায় ফুটে উঠেছে জাতির পিতার প্রতি লেখকের অপরিসীম প্রেম, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মুজিবের সাথে অন্য কোন কিছুর তুলনা চলে না। মুজিবের তুলনা শুধুই মুজিব। এ কথাটিই কবির লেখায় এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
হাট মাঠ ঘাট জ্বালিয়ে দিয়েছে
বাঙালি মেরেছে ঘিরে প্রাণটা বাঁচাতে লুকিয়ে দে ছুট
চায়নি পিছনে ফিরে।
ট্রেনিং নিয়েছে সীমানা পেরিয়ে
অস্ত্র তুলেছে হাতে
সেজেছে কুলি ও মজুর কৃষক ছুটেছে দিন কি রাতে।
তিরিশ লক্ষ জীবনের দামে
স্বাধীন এদেশ পাওয়া
এই ছিল যেন কোটি বাঙালির শত বর্ষের চাওয়া।
(শত বর্ষের চাওয়া)।

হ্যাঁ, বাঙালির শতবর্ষের চাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা সে কাঙ্খিত স্বাধীনতা পেয়েছি। এ স্বাধীনতা পেতে অনেক রক্ত আর ত্যাগ তিতিক্ষায় অবর্তীণ হতে হয়েছে আমাদের। সেই বীরত্ব গাথার কথা লেখকের পদ্যে, ছড়া-কবিতায় উঠে এসেছে, যা পাঠকের ভালো না লেগে পারে না।
কেশব জিপসীর এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১২টি লেখা স্থান পেয়েছে। ২২টি লেখার মধ্যে অন্য লেখাগুলো হলো, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। প্রতিটি লেখা সহজ সরল পংক্তিমালায় স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে সাজানো হয়েছে। কেশব জিপসীর ছন্দ সচেতনতা পাঠককের ভালো না লেগে পারে না কেননা ছন্দ ছড়ায় তিনি পারঙ্গম। তাই তাঁর ছন্দ পাঠককে দোলাবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
আমাদের ছড়ার অঙ্গন থেকে মাঝ পথে বিরতি দেয়া কেশব জিপসী আবার সরব হয়েছেন এ বড় আশার কথা। সে আশা পূরণ করার দৃপ্ত মানসে তিনি একে একে লিখে যাচ্ছেন নতুন নতুন ছড়া কবিতা। বিশেষ করে চট্টগ্রামের আজাদী, পূর্বকোণ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, পূর্বদেশ প্রত্রিকায় তার সরব উপস্থিতি জানান দেয়, তিনি থেমে নেই। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ পাঁচটি বই তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন, যা সোজা কথা নয়।
বইটির প্রচ্ছদে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী উত্তম সেন তাঁর স্বভাব সুলভ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রতি পাতায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক
চিত্রের সংযোজন লেখাগুলোর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।