যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র কি বিপদাপন্ন ?

36

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

৩০ এপ্রিল, ১৭৮৯ ইংরেজিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্থপতি ও জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। যে মূল্যবোধগুলির উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছিল, সে মূল্যবোধগুলি জাতীয় জীবনের মূল আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি এবং তদানীন্তনকালে, আর যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন সবাই মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীকালে ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সাথে যাঁরাই সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন তাঁরা ও আমেরিকার মৌলিক মূল্যবোধগুলি রক্ষার ব্যাপারে সব সময় দৃঢ় ঐক্যমত পোষণ করেছেন। আমেরিকার সাধারণ মানুষও দল মত নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অভিবাসন নীতি সমর্থন করেছেন। এই ব্যাপারে জর্জ ওয়াশিংটনের নিজের কথা শুনলেই বুঝা যায়, আমেরিকার রাষ্ট্র হিসেবে পথ চলার শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বর্তমানে চলমান অভিবাসন নীতি গ্রহণ করেছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন তখন লিখেছিলেন, ‘Rather than quarrel about territory, Let the poor, the needy and oppressed of the earth,and those who want land, resort for the fertile plains of our western country, the second land of promise, and there dwell in peace,fulfilling the first and great Commandment’. অর্থাৎ জায়গা নিয়ে ঝগড়ার পরিবর্তে, অভাবগ্রস্তরা, দরিদ্ররা, অত্যাচারিতরা হওয়া এবং যারা ভূমি অন্বেষণে আছে, আমাদের পশ্চিমাদেশের উর্বর ভূমিতে আশ্রয় নেওয়া উচিত। ইহাই দ্বিতীয় প্রতিশ্রুত ভূমি এতেই ঈশ্বরের প্রথম এবং মহান নির্দেশ পালিত হবে। উপরোক্ত কথাগুলি ১৭৮৫ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখে ডেভিড হামপ্রে নামে এক ভদ্রলোককে লিখেছিলেন। এসব ব্যাপারে এই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট দ্বিমত পোষণ করতে শোনা যায় নাই। জর্জ ওয়াশিংটন থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামা পর্যন্ত যাঁর কথাই আলোচনা করা হউক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন প্রেসিডেন্ট তিনি যে দলেরই হউক না কেন, আমেরিকার স্থপতিদের নির্ধারিত মৌলিক নীতিগুলি থেকে কেহ বিচ্যুত হন নাই।
১৯৬০ সালে ৪২ বৎসর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের একজন তরুণ সিনেটর জন এফ কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তখনকার বিশ্বের যুব-সমাজকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘ÔLet us begin anew remembering on both sides that civility is not a sign of weakness, and sincerity is always a subject of proof,Let us never negotiate out of fear. But let us never fear to negotiate’. অর্থাৎ চলুন আমরা নতুনভাবে আরম্ভ করি, এ কথা স্মরণ করে যে শিষ্টাচার দুর্বলতার লক্ষণ হতে পারে না, আন্তরিকতা সবসময় প্রমাণের বিষয়। আমরা কোনদিন ভীতির কারণে সন্ধি করবো না। কিন্তু সন্ধি আলোচনা করতে ভয় পাব না।
কিন্তু গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য শোকের বিষয় ছিল প্রেসিডেন্ট কেনেডি ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসের ২২ তারিখে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁরই ভাইস প্রেসিডেন্ট জনসন গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুসারে প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘With the death of John Kennedy something seemed to die in each one of us, yet the memory of that bright vivid personality, that great gentleman whose every act and appearance appeal to our pride and gave us fresh confidence in ourselves and our country, will live in us for long time’. অর্থাৎ জন কেনেডি মৃত্যুর পর আমাদের মধ্যে কি যেন একটা সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবুও সে ব্যক্তির আলোকময় উজ্জ্বল উপস্থিতি, প্রত্যেকটা কাজ আমাদেরকে গঠিত এবং আমাদের মধ্যে নতুন আত্মবিশ্বাস জাগাত তা অনেকদিন ধরে আমাদের মধ্যে জাগ্রত থাকবে।
যাই হউক জর্জ ওয়াশিংটন থেকে আরম্ভ করে প্রেসিডেন্ট ওবামা পর্যন্ত উপরোল্লিখিত যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলির উপর গভীর লক্ষ্য রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন চালাতে চেষ্টা করেছেন, এতে কেহ বেশি সফলকাম হয়েছে,কেহ বা সফলতার মুখ কম দেখেছেন কিন্তু এইসব মৌলিক নীতিগুলির ব্যাপারে কেহ নীতিচ্যুত হতে দেখা যায় নাই।কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সব লন্ডভন্ড করে দিলেন। ¯েøাগান তুললেন ‘America FirstÕ’ ট্রাম্পের এই স্লোগানের ফলে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার বন্ধুসুলভ রাষ্ট্রগুলো Inferiority complex বা হীনম্মন্যতায় ভোগা ছাড়া তাদের অন্য কোন পথই ছিল না।
ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে প্যারিসে বিশ্বের প্রায় দেশগুলি জলবায়ু চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, সারা বিশ্বের মানুষ জল বায়ু দূষণের হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারে অনেকটা আশ্বস্ত হল। ট্রাম্প সাহেব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য মূল্যবান এই চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলেন। মাসের পর মাস যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ইরান অক্লান্ত পরিশ্রম করে সবাই একমত হয়ে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈয়ার না করার প্রতিশ্রুতি চুক্তি হলো। ট্রাম্প সাহেব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন।
তারপর তিনি শুরু করলেন ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির সাথে কূটনৈতিক সৌজন্য বহির্ভূত আচরণ। তবে কোন অজ্ঞাত কারণে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পছন্দ করতেন বলে মনে হতো। সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জঈী অনুসারীরা গণতন্ত্রের মন্দির বলে কথিত ‘ক্যাপিটাল হিল’ আক্রমণ করে তার পবিত্রতা নষ্ট করেছে। সমস্ত গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য এই ঘটনা কতটুকু মর্মবেদনার, যন্ত্রণা এবং হতাশার তা বর্ণনা করার শক্তি, সামর্থ্য, কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিশ্বাসী মানুষের থাকতে পারে না। শুধু এইটুকু সান্তনা যে বর্তমানে ঘটনা এবং অতীত ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিনিধি পরিষদে’ অন্তত দুইবার অভিশংসিত হয়েছেন। বর্তমানে এই বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। অথচ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস প্রতিদিন ৪০০ করে লোক প্রাণ হারাচ্ছে। সম্প্রতি ‘ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন’ এর এক গবেষক দল এক পূর্বাভাসে বলেছেন, আগামী ৯ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ মারা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনাই আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
যাই হউক আসল ব্যাপার হলো আমেরিকায় শাসনতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার পরও এক শ্রেণীর ধনী যারা অ্যংলো- আমেরিকান বংশভূত, মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের সম-অধিকার সম্পর্কে যাই লেখা হউক না কেন আমেরিকায় সাদারই শ্রেষ্ঠত্ব। কাজেই আমেরিকানদের কিছু অংশে কদর্য জধপরংস (জাতিগত বিদ্বেষ) এখনো মধ্যে মধ্যে ভয়ানক রূপ নিতে দেখা যায়। কিন্তু ইহাই শেষ কথা নয়। আমেরিকার সকল শ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, মানবিক মর্যাদাবোধ ইত্যাদি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে জাতিগত বিদ্বেষ ও কমতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিগ্রো হওয়া সত্তে¡ও ৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়া এবং ক্ষমতা ছাড়ার পর ও তাঁর জনপ্রিয়তা শুধু অটুট নয় আর ও বেড়ে যাওয়াটাই প্রমাণ করে যে আমেরিকায় বর্ণবাদের বিজয়ের সম্ভাবনা ইতিমধ্যেই শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেছে।
তবে একথা সত্য গণতান্ত্রিক দেশে, প্রতিশ্রুত কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত না হয়, সেক্ষেত্রে জবাবদিহিতার সুদৃঢ় ব্যবস্থা দেখা যায় না। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সমাজে যখন অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্রভাবে দেখা দিল এবং অর্থনৈতিকভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ল, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল এবং রাজনীতির উভয় পক্ষই এই অর্থনৈতিক দুর্দশার কোন সমাধান দিতে ব্যর্থ হলো।
অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক স্কুমপিটার বলেছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফলভাবে কার্যকরী করতে হলে চারটি শর্ত অবশ্যই পূরন করতে হবে। ‘Quality of politicians in terms of ability and moral character social consensus that democracy does not solve everything, a well trained and effective bureaucracy end finally, effective competition for leadership requires large measures of tolerance for difference of opinion’. অর্থাৎ রাজনীতিবিদের দক্ষতা এবং নৈতিক চরিত্র থাকতে হবে, গণতন্ত্র সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, এই সত্যের উপর রাজনীতিবিদরা একমত হতে হবে, অতি দক্ষতা সম্পন্ন একটি আমলা শ্রেণী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মত পার্থক্যের ব্যাপারে সংযম এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।
উপরোক্ত শর্তগুলির প্রায় শর্ত ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে নগ্নভাবে লংঘন করেছেন। প্রথমে তিনি আমেরিকার সমস্ত সংবাদ মাধ্যমকে অহরহ Fake (জাল) বলে আখ্যায়িত করতেন এবং সাথে সাথে তিনি আমেরিকার আমলাতন্ত্রকে এক পয়সার বিশ্বাস করতেন না। তিনি প্রকাশ্যে অহরহ এমন সব মন্তব্য করতেন যা সামাজিক বিভক্তিতে ইন্ধনের খোরাক হিসেবে কাজ করত। যাই হউক আমেরিকার জনগণের মধ্যে সম্পদের যে ভয়ানক বৈষম্য বিরাজ করছে তাতে কোন সন্দেহের কোন কারণ নেই। সম্পদের আকাশ পাতাল পার্থক্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার একটি প্রধান কারণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য কোন জাতিকে মহান করতে পারে না। এই সম্পদ বৈষম্য কমানোর একটি জোর প্রয়াস অবশ্যই আমেরিকার সমস্ত শক্তিগুলিকে নিতে হবে, তবেই আমেরিকার সত্যিকারের মহত্ত্ব বিশ্বব্যাপী নিঃসন্দেহে বিকশিত হবে।
আমেরিকা সিনেটে ট্রাম্পের অভিশংসনের ব্যাপারে যে ভোট হয়েছিল, তাতে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৫৩ জন সিনেটর বিরুদ্ধে দিয়েছেন ৪৩ জন সিনেটর। যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রস্তাবের পক্ষে যায় নাই সেজন্য ট্রাম্প অভিশংসন থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
লেখক: কলামিস্ট