যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ, ঋণ নয় বাকি বিশ্বের লগ্নী

26

শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী

করোনা মহামারীর ফলে সারা বিশ্বের সব উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত সব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবেলা করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রত্যেক দেশের সরকারের জন্য একটি দুরূহ ও সংকটপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিশাল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে গিয়ে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে না পারায় অনেক জরুরী অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে এই প্রকল্প গুলির ভবিষ্যতে খরচও বেড়ে যাবে। সারা বিশ্বের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু গতিহীন হয় নাই, কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে বিশ্বের অনেক দেশ করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনকে অনর্গল দোষারোপ করা ছাড়া, করোনার নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং নিজেদের অর্থনীতি গতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়াস অনেকদিন পর্যন্ত নিতে দেখা যায় নাই। ফলে সারা বিশ্বে করোনা সৃষ্ট সমস্যাগুলো আর ও ব্যাপক এবং প্রবল আকার ধারণ করেছে।বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিশ্ব অর্থনীতির যে চিত্র দিচ্ছেন তা দেখলে শিউরে উঠতে হচ্ছে। ও,ইসিডির সাম্প্রতিক দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৎসর (২০২০) বিশ্বের উৎপাদন হয় ৩.৪ শতাংশ কমে গেছে। তবে তাদের মতে ২০২১ সালের বিশ্বের উৎপাদনের হার হবে ৫.৫ শতাংশ। ২০২২ সালে হবে ৪ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হবে না। বিশ্বের বড় দেশগুলির মধ্যে একমাত্র চীনই ২০২০ সালে অর্থাৎ চরম করেনাকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল।অথচ ঐ বছরেই ইউরোপে উৎপাদন কমেছিল ৬.৮ শতাংশ। ফ্রান্সে কমেছিল ৮.২ শতাংশ স্পেনের ১০.১ শতাংশ,
ইংল্যান্ডে দশমিক ৯.৯শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ২০২০ সালে ভারতের উৎপাদন কমে ছিল ৭.৪ শতাংশ, মেক্সিকো ৮.৫ শতাংশ,দক্ষিণ আফ্রিকা ৭.২ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনা ১০.৫ শতাংশ। শুধু আগামী দুই বছর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইহা ছাড়া আমেরিকানদেরকে দ্রুত ভ্যাকসিন দেওয়াসহ কভিড ১৯ থেকে মুক্ত হওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলির রাজস্ব খাতে জিডিপির ১৩.৩ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দেশগুলির রয়েছে ১০.৩ শতাংশ এবং স্বল্প আয়ের দেশগুলির রয়েছে ৫.৭ শতাংশ। বৈশ্বিকভাবে ২০২০ সালে রাজস্বখাতে বিশ্বব্যাপি প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো সরকারের বরাদ্দ করতে হয়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী সর্বসাধারণের ঋণের পরিমাণ জি,ডি,পির ৯৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছে অথচ এই অংক ২০১৯ সালে ছিল জিডিপির ৮৪ শতাংশ সংক্ষেপে বলতে গেলে বিশ্বের প্রত্যেকটা দেশ করোনার কারণে টাকা খরচ করতে দ্বিধা করে নাই, এই খরচে তারা কতটুকু উপকৃত হবে তাও তাদের চিন্তায় ছিল না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৯ সালে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৬.৪ শতাংশ অথচ ২০২০ সালে সে রাজস্ব ঘাটতি এক লাফেই ১৭.৫ শতাংশে পৌঁছে গেল। আইএমএফের হিসাব মতে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালে ঋণ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ১২৮.৭ শতাংশ অথচ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে তা হলো জিডিপির ৯৭.৮ শতাংশ। আর চীনের ঋণ হলো জিডিপির ৬৫.২ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। রিপাবলিকান দলের সিনেটারেরা এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এই প্রণোদনার বিরুদ্ধে তাঁরা ভোট দিয়েছেন। তাদের মতে এই প্রণোদনার সুদ এবং অন্যান্য খরচ সহ ২০৩১ সালে সর্বমোট ৪.১ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।কারণ সকল প্রণোদনার ব্যাপারে দেখা গেছে যে অংক ঘোষণা করা হয়, শেষ পর্যন্ত তার থেকে অনেক বেশি খরচ করতে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ও অন্য কোন উপায় নেই। কারণ তিনি যদি অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হন ২০২২ সালে পুনঃনির্বাচিত হওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠবে না।
সুতরাং বৈশ্বিক কৌশলগত দিক বিবেচনা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে, প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়,যেভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছিল, তাঁর চার বৎসর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতাকালীন সময়ে ভেঙে চৌচির করে দিয়েছিলেন।কাজেই প্রকৃত ইস্যু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঝগড়ার ব্যাপার নয়। প্রকৃত সমস্যা হল ট্রাম্পের ৪ বৎসর আমেরিকা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং চীনের প্রেসিডেন্টের পক্ষে অল্প সময়ে সঠিক অবস্থায় আনা সম্ভব কিনা?১৯৮১ সালে যখন রোনাল্ড রিগ্যান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি বলেছিলেন, Government is not the solution to to our problem government is the problem. অর্থাৎ সরকার আমাদের সমস্যার সমাধান নয়, বরং সরকারই সমস্যা। রিগেনের সময় সরকারের ঋণ বেড়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছিল যা ছিল তখনকার জিডিপির ৩১ শতাংশ কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৭ ট্রিলিয়নে যা সর্বমোট জিডিপির ১৩৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক মুদ্রা নীতি হিসেবে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যে স্থিতিশীলতা, দীর্ঘ সময় ধরে সুদের হার সংযত রাখা। যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে রয়েছে, বেকারত্বও নিম্নহার রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে সুদের হার ও নিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
আগামী চার বছরের মধ্যে সবুজ অবকাঠামো বিনির্মাণে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথচ এর আগে শুধু দেশরক্ষা খাতে ২০১৯ সালের এক বছরে খরচ করা হয়েছিল ৩৮৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত ও যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে ৮০১০০০ জনের। উপরোলি­খিত খরচ গুলি ঋণের উপর নির্ভর করে করা হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের বাজেট অফিসের হিসাব অনুযায়ী এই ঋণ ২০৫১ সালে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ২০২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। অন্য কোন দেশে সরকারি ঋণের উপরোলি­খিত অবস্থা অনুরূপ হলে একে তাচ্ছিল্য স্বরূপ বানানা রিপাবলিক (Banana Republic) বলে আখ্যায়িত করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এরূপ আখ্যায়িত করা বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের সাহস সঞ্চয় করা সম্ভব হবে কিনা বলা যায় না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য যে প্রণোদনা (Stimulus) দেওয়া হচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সবল ও সুস্থ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু উপরোক্ত প্রণোদনার খরচ সঞ্চয় থেকেও করা হচ্ছে না বা এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ধনকুবরদেরকে ট্যাক্স দিতে বাধ্য করা হচ্ছে না। এই প্রণোদনার খরচ হচ্ছে ডলার ঋণ নিয়ে। আমেরিকার ঋণ সম্পর্কে আসল সত্য হলো ইহা ঋন নহে বরং ইহা বাকি বিশ্বের লগ্নী (Equity)। আমেরিকার এত বিশাল ঋণদাতাদের বঞ্চিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই কারণ তাদের ডলারের উপর লেখা রয়েছে ‘In god we trust’ বা ঈশ্বরে আমরা বিশ্বাস করি।
যুক্তরাষ্ট্র কি করোনার ভয়াবহ সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে? হ্যাঁ পারবে কারণ ডলারের নোট বলে ‘আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’।

লেখক: কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক