যাপিত জীবনের অপ্রকাশিত কথা

55

আমাদের দেশে গ্রাম পর্যায়ের সমাজের সর্দার বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, আমাদের জনপ্রতিনিধি, দেশ ও সমাজের বেআইনী কর্মকান্ড প্রতিরোধে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্ণধারগণ, আমাদের মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট সবারই মস্তিষ্কে এটা এমনভাবে গেঁথে আছে যে, নারী অবলা, তারা পুরুষদের দ্বারা নির্যাতিত। আমাদের মিডিয়া, আমাদের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আমাদের নেতৃবর্গ, আপামর জনগণ সবাই পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। যে কোন নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে সোচ্চার হওয়াটা অত্যন্ত মানবিক একটি বিষয় এবং এটি দায়িত্ববান নাগরিকেরই কাজ। আমাদের দেশের নারীরা এখন আর অবলা নন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল, চিকিৎসা, পুলিশ, আনসার, সেনা, নৌ, বিমান, প্রশাসনিক ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ, ব্যবসা বাণিজ্য সহ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সর্বত্রই রয়েছে আমাদের নারীদের সফল পদচারণা। পারিবারিক আবহে আমাদের নারীরা যেমন স্নেহ, প্রেম-ভালোবাসা আর মায়া মমতার শ্রেষ্ঠ আধার, ঠিক তেমনি কর্মক্ষেত্রে তারা নিজ দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত দক্ষ এবং চৌকষ। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের বিশ^স্ততা, দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা পুরুষের চাইতেও বেশি।
সাড়ে ষোল কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত আমাদের বাংলাদেশের নগরে, গঞ্জে, গ্রামে কত হাজার হাজার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নারীদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। ধনী-গরিব, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত, অতি ধনী সকল শ্রেণির পরিবারের মধ্যে নারী কর্তৃক পুরুষ নিগ্রহের এই মারাত্মক ব্যাধিটি সারাদেশে একটি জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। অথচ এই সমস্যা দূরীকরণে সরকারি, বেসরকারি, মিডিয়া বা সামাজিক সংগঠন কারো কোন উচ্চ-বাচ্য বা উদ্যোগ নেই। যেন দেশে এই জাতীয় কোন সমস্যাই নেই। এর কারণ আমাদের মস্তিষ্কে শুধুমাত্র নারী নির্যাতনের বিষয়টিই প্রোথিত, পুরুষ নিগ্রহের বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা সত্তে¡ও এর প্রতিবিধানে আমরা নির্বিকার। কত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের মিডিয়া সোচ্চার হয়, কিন্তু পুরুষ নিগ্রহের মত পরিবার বিনাশী জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মিডিয়ার নিরবতা চরম বিষ্ময়কর। পুরুষের হাতে নারী নির্যাতনের খবর প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় আসে, অথচ নারীর হাতে পুরুষের নির্যাতিত হওয়ার কোন খবর কখনো মিডিয়ায় প্রচার হয় না। সব পুরুষ যেমন নারী নির্যাতনকারী নয়, তেমনি সব নারী পুরুষদের নিগ্রহ করে না। নারীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনকারী পুরুষদের মত আমাদের সমাজে এমন এক শ্রেণির নারী রয়েছেন যারা বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যে শ^শুর বাড়িতে তাদের স্বভাবগত কূটকৌশলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরাজমান সুসম্পর্ক বিষিয়ে তোলেন। এই শ্রেণির নারীরা নম্রতা-ভদ্রতার পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারিতা, উদ্ধত ভাব-ভঙ্গি প্রদর্শন আর অমার্জিত আচরণের মাধ্যমে শ্বশুর বাড়িতে বিরাজিত শান্তির পরিবেশে বপন করেন অশান্তির বীজ। বাবা-মা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে অনেক আশা নিয়ে তাঁদের ছেলের বউ করার জন্য মেয়ে নির্বাচিত করেন। বাবা মায়েরা তাদের যতটুকু সংগতি তার মধ্যে থেকে ধুমধামের সাথে অত্যন্ত সমাদরে ছেলের বউকে বরণ করেন। ছেলের বউদের একাংশ তাদের মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া আদব-কায়দা এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জিত শিক্ষার নির্যাস গুনে নিজের বরের পরিবারের সাথে মানিয়ে চলেন এবং ধীরে ধীরে ঐ পরিবারের একজন দায়িত্ববান এবং সবার প্রিয় নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়ে উঠেন। ক্রমে ক্রমে শ^শুর বাড়ি এসব বউদের কাছে এত আপন হয়ে উঠে যে, বাপের বাড়ি তাদের কাছে গৌন হয়ে পড়ে। এই নববধূদের অপর অংশটি তাদের পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সামান্যতম জ্ঞানও অর্জন করতে পারেন বলে মনে হয় না। নিজের বরের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে তারা নিজেদের মানিয়ে চলতে পারেন না। মানবিকতা, আদব-কায়দা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, ধৈর্য, আবেগ এসব তাদের কাছে অপরিচিত শব্দ। ননদ-জা, দেবর-ভাশুর, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সবার সাথেই এই শ্রেণির বউদের খুব দ্রæতই ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে যায়। এসব বউয়ের একমাত্র লক্ষ্য থাকে তার বরটি যেন তার অনুগত হয় এবং তার কথায় উঠ-বস করে। বরটি যদি মেরুদন্ডহীন হয় এবং বউয়ের অনুগত হয় তখন সংসারে অনিবার্যভাবে বাজে ভাঙ্গনের সানাই। আর বরটি যদি বউয়ের কথায় সায় না দিয়ে তার পরিবারের ভাঙ্গন রোধে এবং শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট হয় তাহলে সেই বরের উপর নেমে আসে নির্যাতন। সারাক্ষণ বরের উপর খবরদারী আর চোখরাঙানি, নিজের মতামত বরের উপর চাপানো, নিজের সিদ্ধান্ত বর এবং বরের পরিবারকে মানতে বাধ্য করার চেষ্টা, বরের গায়ে হাত তোলা অথবা ‘হাতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে’ এবং অশ্রাব্য গালাগাল দেওয়ার মধ্যেই শুধু এই নির্যাতন সীমাবদ্ধ থাকে না। বরের পরিবার সম্পর্কে বানোয়াট ও নেতিবাচক কথাবার্তা বলার মাধ্যমে শ^শুর বাড়ির সদস্যদের অপদস্ত-অপমান করে এসব বউয়েরা বিকৃত পূলক অনুভব করে থাকেন। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে ছেলের জন্য বউ আনা বাবা-মা, আত্মীয় পরিজনের স্বপ্নের সমাধি ইতিমধ্যে রচিত হয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের হৃদয় মথিত দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জলের নিরব বিসর্জনের খবর মিডিয়ায় আসে না। ‘দুঃখের দহনে করুণ রোদনে’ পুরুষ সমাজের এই বিরাট জনগোষ্ঠীর দিন কাটে।
শ^শুর বাড়িতে আসা বাপের বাড়ির মেহমানদের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন, আর শ^শুর বাড়ির পক্ষের মেহমানদের জন্য দায়সারা গোছের আপ্যায়ন এসব বউদের কু-খাসলতের অংশ। এই শ্রেণির বউদের আচরণ তাদের বরদের এবং শ^শুর বাড়ির সকল সদস্যদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এরা নিত্যনতুন ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে, ঝগড়াঝাটির নূতন নূতন কারণ সৃষ্টি করে শারীরিক, মানসিক, আর্থিকভাবে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের আধমরা করে ছাড়েন এবং বাড়ির পরিবেশ নরক করে তোলেন। শশুরবাড়ির সদস্যদের এবং নিজের বরকে বশংবদে পরিণত করার এবং তাদেরকে নিজের কর্তৃত্বাধীন রাখার জন্য কৌশল উদ্ভাবনে এসব বউদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত উর্বর। মমতাময়ী নারীর বিপরীতে এরা বদ খাসলতের মূখরা নারী, যাদের বিষকন্যা ছাড়া অন্য কোন নামে আখ্যায়িত করা যায় না। কালনাগিনীর উদ্ধত ফনার মতই অসৌজন্যমূলক ভঙ্গিতে এ সকল বিষকন্যারা আমাদের সমাজে তাদের ঠোঁটের আর লক্লকে জিহ্বার বিষ উদ্্গীরন করে আমাদের সমাজের গৃহদাহ করে চলেছেন। তাদের ঝগড়াটে দজ্জাল আচরণ ঐতিহাসিক খল চরিত্র ঘসেটি বেগমকে ছাড়িয়ে যায়। এসব বউদের কূ কাজের দোসর হিসাবে আবির্ভূত হন তাদের বাপের বাড়ির সদস্যরা, তাদের মায়েরাও এতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। মেয়ের শ^শুর বাড়ির বিষয়ে মেয়েকে সঠিক উপদেশ-পরামর্শ দেওয়ার পরিবর্তে এসব সদস্য মেয়েকে তার কাজে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। বউয়ের বাপের বাড়ির সদস্যরা বউকে শ^শুরবাড়ির পরিবেশের সাথে এবং শ^শুরবাড়ির সকল সদস্যের সাথে মানিয়ে চলার পরামর্শ দিলেও এই শ্রেণির মেয়েরা সেসব সৎ উপদেশের পরোয়াই করে না।
এই স্বভাবের মেয়েদের বা বউদের স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বৈরাচারী কাজের একটি বড় কারণ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০৩’। এসব বউয়েরা নিজেরা অপরাধ করে তা ঢাকা দেওয়ার জন্য তারা নিজেদের বর এবং বরের বাড়ির লোকজনদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা ঠুকে দিয়ে এই আইনের ছায়ায় নিরাপত্তা খোঁজেন। এই আইনের অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারাদেশে শতশত মিথ্যা-বানোয়াট মামলা সৃষ্টির কাজে এক শ্রেণির মানুষ এই ধরনের নারীদের সহযোগিতা করে চলেছেন। আমাদের সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদ সকল নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। নারী নির্যাতন রোধের জন্য অবশ্যই এই আইনের প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী পুরুষ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর তাদের বউদের নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য এখনও পর্যন্ত কোন আইন প্রণীত না হওয়া অত্যন্ত বিষ্ময়কর। এখন আমাদের দেশের পুরুষ সমাজ মনে করে যে, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতিত হওয়া এবং তাদের দায়ের করা মামলার ঘানি টানতে কোর্ট কাচারীতে হাজিরা দিয়ে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে সর্বস্বান্ত হওয়াই তাদের কপালের লিখন। এই নির্যাতনের বিচার চাওয়ার কোন সুযোগ তাদের নেই। আইনের আশ্রয় নেওয়ার মত তাদের জন্য আইন নেই। বাস্তবতা হলো সমাজ, রাষ্ট্র, মিডিয়া, আইন সবই নারীদের পক্ষে। অসংখ্য সামাজিক সংগঠন নারীদের সাহায্যের জন্য এক পায়ে খাড়া।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি একজন দক্ষ প্রশাসক। নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য ‘পুরুষ নির্যাতন নিরোধ বিষয়ক একটি আইন’ সংসদের আগামী অধিবেশনে পাস করানোর মাধ্যমে এদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অন্তরের একান্ত চাওয়াকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আপনার সমীপে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি।

লেখক : সমাজকর্মী