ম্যাজিস্ট্রেটের খবরে সব হাওয়া !

28

বেলা ১২টা। দক্ষিণ কাট্টলীর হালিশহর রোড। বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) ঘর থেকে বের হতেই দেখি দোকানপাট সব বন্ধ। রিকশা, টেম্পো, গাড়ি চলছে। ভাবলাম, মানুষ মনে হয় নিজ থেকেই সচেতন হয়েছে। একটু হেঁটে টেম্পোতে উঠলাম। ফইল্যাতলী বাজারের আরো আগে গাড়ি থেমে গেল। আগে রিকশায় যেতাম ভাড়া দিতে হত ১০ টাকা। এখন ২০ টাকার কমে রিকশা ড্রাইভাররা চলেন না। চলাচল নিষিদ্ধ ব্যাটারি রিকশাগুলো নাকি প্রতিদিন ২৫০ টাকা কন্ট্রাক্টে সড়কে গাড়ি বের করে। এরপর আছে মালিকের টাকা। টেম্পো ভাড়া আগে ৫ টাকা ছিল। ৩১ মার্চ থেকে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণায় ১০০ শতাংশই বাড়িয়ে দিল তারা। অর্থাৎ ১০ টাকা দিতে হল। ওইদিন দেওয়ানহাট গেলাম। দিতে হয়েছে ২০ টাকা। আগে দিতাম ১০ টাকা। ৬০ ভাগ বাড়ানোর কথা বললে মহাশয় ড্রাইভার ভাইয়েরা মানেন না। যাত্রীদের সাথে বচসা শুরু করেন। অনেক ড্রাইভার তো রীতি মতো প্রতারণা শুরু করেন। দেখলাম, আগ্রাবাদ থেকে আসা ১ নম্বর রুটের টেম্পো দেওয়ান হাট এসে সব যাত্রী নামিয়ে দিল। ভাড়া নিল ডাবল। অর্থাৎ আগে ৫ টাকার এ ভাড়া কাটল ১০ টাকা করে। ড্রাইভার মহাশয় নেমে এক খিলি পান ঢুকালেন মুখে। ঠিক দুইটা মিনিট পর আবার স্টার্ট দিলেন চকবাজার বলে ডাক দিলেন। আর অমনি হুমড়ি খেল যাত্রীরা। একই গাড়িতে করে আসা এক মহিলা আবার যাত্রী হলেন এখানে। নামবেন টাইগারপাস। দেওয়ান হাট থেকে ভাড়া ৫ টাকা। কিন্তু ডাবল দিতে হলে ১০টাকা। এই হল আমাদের রুটগুলোর অবস্থা। যাত্রীরা সবসময় জিম্মি। একটাই কারণ, গাড়িগুলো প্রতিদিন চাঁদা দিচ্ছে। এ চাঁদা ট্রাফিক পুলিশ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ কথিত আছে মন্ত্রীপাড়ায়ও এর ভাগ যায়। তার কোনো ডকুমেন্ট ঠিক না থাকলেও চলে, কারণ সে ‘মান্থলি’ বা প্রচলিত শব্দ ‘মাল্টি’ যা মাসিক ট্রাফিক টোকেন নামে পরিচিত ড্রাইভারদের কাছে সেটি সংগ্রহ করেছে। সুতরাং সড়কে তার সাত খুন মাফ। এভাবেই চলছে আমাদের গণপরিবহনগুলো। যাত্রী যেখানে জিম্মি। মনে পড়ে গেল শিক্ষার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আন্দোলনের কথা। হলো না কিছু। আক্ষেপ করেই বলতে হয় -কুকুরের লেজ নাকি ১২ বছর চুঙ্গায় ঢুকিয়ে রাখলেও সেটি সোজা হয় না।
ফিরে আসি আসল কথায়। ফইল্যাতলী বাজারে ঢুকে দেখি দোকানপাট এখানেও বন্ধ। কেউ কেউ বন্ধ করছেন, কেউ কেউ বন্ধ করে চলে গেছেন। ব্যাপাার কি? একবার ভাবলাম বেরিয়ে যাই, কিন্তু বাজার যে করতে হবে। এগিয়ে গিয়ে দেখি যে দোকান থেকে প্রতি মাসে বাজার করি সেটি খোলা আছে। জিজ্ঞেস করতে সওদাগর বললেন, ম্যাজিস্ট্রেট বাজারে ঢুকেছেন। তাই সব দোকান বন্ধ। অবাক হলাম। ম্যাজিস্ট্রেট আসলেন সব দোকান বন্ধ!!! মানে কয়েকজনের সাথে আলাপে জানলাম, হালিশহর রোডের বেশির ভাগ দোকানে নেই ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য কোনো স্বীকৃতি। অনেকগুলো ওষুধের দোকানের তো ড্রাগ লাইসেন্সই নেই। এরপর এগুলোতে আবার ভুয়া ডাক্তারও বসে চিকিৎসা সেবা দেয়। দুইবার অভিযানে তো এক ভুয়া ডাক্তার ধরাও পড়ল। কিন্তু সেই ভুয়া ডাক্তার এখনও বহাল তবিয়তেই আছে। খবর পাওয়া গেল কি সব রেজিস্ট্রেশন নম্বরযুক্ত করে নিয়েছে। এর থেকে বড় বিষয় ধরা খাওয়ার পর এখন নাকি ওই যে ‘মান্থলি’ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তা মহাশয়রা চেম্বারে আসা-যাওয়া করেন রীতিমত। পরিচিত এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম কি রে ভাই আপনার দোকান বন্ধ কেন? তিনি শুনালেন ভাই সবাই বন্ধ করেছে আমিও করলাম। পাশ থেকে এক পথচারী বলে উঠলেন বুঝলেন না ‘ম্যাজিস্ট্রেটের খবরে একটু সরে থাকাই ভালো’। তাই তো দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটের খবরে সবাই হাওয়া হয়ে যায়!
ভাবতে গা শিউরে উঠল, ম্যাজিস্ট্রেটের খবরে রীতিমত সব বন্ধ। তার মানে আমরা দুই নম্বর কাজে ডুবে আছি। একি এক হুজুরের দোকানও দেখি বন্ধ। তার মানে হুজুরও ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া…? সব যেন অবৈধ।
আমরা কি তবে অবৈধ পথে চলতেই বেশি পছন্দ করি? কোনো দোকানে যান দেখবেন জিনিসের দাম কিন্তু কম নেই। একটু খবর পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়া হবে। হাজার অযুহাত। কিন্তু ব্যবসা করতে বা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে যে সরকারের ট্যাক্স বা কর প্রদান করতে হয় আমরা সেসব পালন করতে অভ্যস্ত নই। আর সাধারণ নাগরিক হিসাবে যেন আমাদেরও কোনো জিজ্ঞাসা নেই কারো। কিরে ভাই ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে তো আপনার দোকান বন্ধ করবেন কেন? তার মানে নাগরিকদের সামনে সমানে সবাই অন্যায় -অনিয়ম করছি।

লেখক: সাংবাদিক