মো. আবদুর রহিম

102

সফলভাবে যাত্রা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। ২০ ও ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রি. অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল। প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কাউন্সিলর, ২০ হাজার ডেলিগেট আর অতিথি মিলে প্রায় ৫০ হাজার বঙ্গবন্ধু প্রেমিকের মিলন মেলা বসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দৃপ্ত শপথে বলিয়ান বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি, ৪ বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১তম জাতীয় সম্মেলন দেশকে ভালোবেসে রাজনীতি করতে নেতাকর্মীদের আহ্বান জানান। তিনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে আওয়ামী লীগ সদা সর্বদায় কাজ করে কাজ করে যাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগে রাজনীতির মাধ্যমে নীতি-আদর্শ নিয়ে চলার আহ্বান জানান। জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৯ম বারের মত সভাপতি পদে নির্বাচিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। এ পদে তিনি ৩৮ বছর ধরে দায়িত্বে আছেন অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক পদের দ্বিতীয় মেয়াদি দায়িত্ব পেলেন জনাব ওবায়দুল কাদের। ২০১৬ সালে ২২ ও ২৩ অক্টোবর একই স্থানে অনুষ্ঠিত ২০তম জাতীয় সম্মেলনে জনাব ওবায়দুল কাদের প্রথম বারের মত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭০ বছরের পথ চলার ইতিহাসে নেতাকর্মীদের ত্যাগের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হওয়ার পর প্রায় ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিকূল নানা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জীবনের বন্ধুর পথ পাড়ি দেন তিনি। ১৯৮১ সালে ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসীন হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেই দিনের জাতীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলর ডেলিগেট ছিল ৩ হাজার ৮৮৪ জন। সে সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনা সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৭ মে ১৯৮১ খ্রি. স্বদেশে এসে দলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি আজ ৪র্থ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭০ বছরে ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ এ সময়ে সম্মেলনগুলোতে শত শত নেতাকর্মী নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে অনেক ত্যাগী নেতারা পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে স্মৃতির পাতায় অমর হয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বাঙালির অধিকার ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অবদান, নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রাচীন এই দলটির ইতিহাসে ২১তম জাতীয় সম্মেলন পর্যন্ত সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র ৭ জন। তন্মধ্যে টানা ৯ম বারের মত সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকটা বিরল। সভাপতি ৭ জনের মধ্যে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও দলের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৩ বার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ২ বার, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও আবদুল মালেক উকিল ১ বার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন দলের দুঃসময়ে ১ বার দলের আহ্বায়ক ছিলেন। ৭০ বছরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন। এ পদে ৪ বার সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্বে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিল্লুর রহমান। এ ছাড়া তাজউদ্দিন আহমদ ৩ বার, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ২ বার করে দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, আবদুল জলিল ১ বার করে দায়িত্ব পালন করেন। জনাব ওবায়দুল কাদের বিনা ২ মেয়াদে দায়িত্ব পেলেন।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন এবং বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস। এ রাজনৈতিক দলটি এদেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ দলটির নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদেশে অসাম্প্রদায়িক প্রগ্রতিশীল ও তরুণ মুসলিম লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পুরনো ঢাকার কেএম দাস লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে একটি রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতা-কর্মীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতত্বে শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির যে জাগরণ ও বিজয় সূচিত হয়, সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ এবং এই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চারনেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ। এরপর দলের মধ্যে ভাঙ্গনও দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। তিনদশক ধরে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। এই সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি তিন বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে দলটি। আবার ৬৭ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে।
২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজয়ের পর অনেকটা সুসংহত হতে সক্ষম হয়ে জোটসরকার বিরোধী আন্দোলনে সফলতার পরিচয়ও দিয়েছিল দলটি। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জরি করে তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে আবারো নতুন সংকটের মুখে পড়ে যায় দলটি। দলীর সভাপতি শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির অসংখ্য নেতারা গ্রেপ্তার এবং একাংশে সংস্কার তৎপরতায় কিছুটা সংকটে পড়ে দলীয় কার্যক্রম।
তবে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে নির্বাচনের বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা চতুর্থ বারের মত প্রধানমন্ত্রী হন।
নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সুখী, সমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়াসহ বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছে দলটি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও
জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ