মোহগ্রস্ত সমাজের নির্মোহ প্রতিবেদন

34

আবু ওবাইদা আরাফাত

কথাসাহিত্য মূলত সমাজের আয়না। যাপিত জীবনের বিম্বিত আলাপ বিশদভাবে তুলে ধরতে প্রায় লেখক গল্পের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। জসিম উদ্দিন মনছুরি মূলত কবি হলেও নাবলা কথার সবিস্তার প্রকাশ ও একই সাথে সমাজের প্রতি ‘এক গুচ্ছ মেসেজ’ ছুঁড়ে দিতেই বিম্বিত প্রতিচ্ছবির দ্বারস্থ হয়েছেন। গ্রন্থের নামকরণ ‘বিম্বিত প্রতিচ্ছবি’ হচ্ছে মূলত সময়ের, সমাজের, মানুষের। উত্তম পুরুষে লেখা প্রায় সবক’টি গল্পে লেখক জসিম উদ্দিন মনছুরি তাঁর যাপিত জীবনের নির্যাসটুকু চিন্তার কালি দিয়ে কাগজস্থ করেছেন। সমাজের আঁকেবাঁকে মানুষের নানাবিধ মোহগ্রস্ততার আকুলিবিকুলি উঠে এসেছে ১১ টি গল্পে। অঙ্গুরি, অদৃশ্য প্রেম, সতীত্ব, অদ্ভুত নেশা, ঘূর্ণিঝড়, সফরকাব্য, ব্যাচেলর দিনগুলি, কর্মদোষে, কামার্ত ভোগে, বহুগ্যামি, সহপাঠ প্রভৃতি নাম শিরোনামের সবিস্তারে তিনি একই সাথে প্রেম, কাম, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, সমাজের বিষপোড়া খ্যাত সুদব্যবস্থা, অসাধু বিচারকর্তা, তাবিজ হুজুর, বহুবিবাহ, ধর্ষণ, মাদক, যৌতুকসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি সচেতনভাবে পাঠকমহলের কাছে উপস্থাপন করছেন। এসব বাস্তব ছবির প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে তিনি কোনপ্রকার ভণিতা কিংবা বাক্যবাহুল্যতার আশ্রয় নেননি। গল্পগ্রন্থ হলেও পুরো রচনার কোথাও গদ্যের ভার পরিলক্ষিত হয়নি। প্রাঞ্জলবাক্যের সুনিপুণ গাঁথুনিতে প্রায় প্রতিটি লাইনে পদ্যের দ্যোতনা পাঠককে বিমোহিত করবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অল্প কথায় জটিল বিষয়ের সহজ বয়ান এ গ্রন্থকে করেছে নির্মেদ ও একইসাথে সুখপাঠ্য।
ভোগ আর উপভোগের পার্থক্য নিরূপণ করছেন তিনি এভাবেই- ‘বরাবরই আমি উপভোগে বিশ্বাসী। ভোগ ক্ষণিকের; কিঞ্চিৎ আনন্দে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু উপভোগের স্থায়িত্ব জন্ম-জন্মান্তর। উপভোগে ভোগ আছে, এর আনন্দটাও চিরস্থায়ী।’
কিছু বাস্তবতার রিভিশন স্বরূপ লিখেন- ‘বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কী আসলে বন্ধুত্ব হয়! একজন নারী পুরুষের কাছে কি চায়? পুরুষই বা কি চায় নারীর কাছে?’
অদৃশ্য প্রেম নামক গল্পে লেখক মনছুরি যেন পাঠকের মন চুরি করলেন; গল্পে এভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর
স্বভাবসূলভ কবিসত্তা- ‘যেখানে আমি অর্ঘ্য দিয়ে ফুলের সুবাসে ধন্য হই। ফুলেরা প্রাণ ফিরে পায় ফুলের বসন্তে। চৈতালি হাওয়ায় ভ্রমরের গুঞ্জনে, অমৃতের সন্ধানে। যেখানে ভাঙামনে রিক্তদহন হয়।’
বেশ কয়েকটি গল্পে লেখক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নিজস্ব ঢঙে তুলে ধরেছেন এতদঞ্চলের মানুষের মনোযাতনা ও সামাজিক টানাপোড়েন। যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নিগ্রহের চিত্র উঠে এসেছে এই লাইনে-
‘তুই জাগই। তোর বরঅত কী দিইয়্যেদে?
বউত দিইয়ে আর হতো দিবো? তুঁই ত হারা ভুলি যঅ গই। তোঁয়াত্তুন হনো শোহর নাই।’
ঘরে স্ত্রী থাকার পরেও সাধুমিয়ার চারিত্রিক সনদ উঠে এসেছে এভাবেই- ‘টাকার জোরে এখনো তার হৃদয়ে কামনার জয়ধ্বনি বাজে। নিষিদ্ধ পল্লীর নিষিদ্ধ বৃক্ষের তরুলতায় প্যাঁচাতে তার অজগরটা ফুঁসেফাসে ওঠে। এই রাগ ঘরের দুধ-কলায় প্রশমিত হয় না।’
এদিকে বহুবিবাহের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে লিখেন- ‘সবুজ বাবার পথে হাঁটে, কিন্তু কিছুটা হিসাব করে। শরীয়াহ সম্মতভাবে সে চারের অধিক বউ রাখে না! তালাক দিয়ে বা মেরে তাড়িয়ে যেভাবেই হোক; চারজনই রাখে। এটাই তার শরীয়াহ!
পেশায় একজন ব্যাংকার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কৃতিসন্তান গল্পকার জসিম উদ্দিন মনছুরি মূলত অসুস্থ সমাজের কয়েকটা প্রধান রোগকে চিহ্নিত করেছেন, যে রোগের সংক্রমণ হতে আশু নিরাময় একান্ত জরুরি।
একজন সমাজসচেতন লেখক হিসেবে তাঁর চিন্তা-দর্শন, বিষয় নির্বাচন, বর্ণনাশৈলী ও পর্যেষনায় ঋদ্ধ গল্পগ্রন্থটি পাঠকমনে কেবল সাহিত্যসূধাই নয় পরিশুদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেই একান্ত বিশ্বাস।
গলুই প্রকাশনের ব্যানারে ৬৪ পৃষ্ঠার বইয়ের মলাট মূল্য মাত্র ১৭৫ টাকা। প্রাবন্ধিক ও প্রকাশক কাজী সাইফুল হকের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শেখ সাদী।