মেডিকেল উচ্চশিক্ষার সমস্যাসমূহের সমাধানে করণীয়

19

 

আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মেডিকেল উচ্চ শিক্ষা বা স্নাতকোত্তর শিক্ষার সমস্যাসমূহের সমাধানে করণীয় সম্পর্কে।
সরকারের করণীয় :
ক) স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী কমপক্ষে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া।
খ) সরকার কর্তৃক জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে মেডিকেল স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার রোডম্যাপ তৈরি করা।
গ) দেশে মানসম্মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির লক্ষ্যে একটি সমম্বিত স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা :
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়,বিএমডিসি ও বিএমএ সমম্বিত উদ্যোগ নিলে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা যেতে পারে।যদি এমন পরিকল্পনা করা যায় যে,বিসিপিএস মূলতঃ জেনারেল বিষয়গুলোতে এফসিপিএস দেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্পেশালিটি বিষয়সমূহে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যেমন এমডি, এমএস ইত্যাদি ডিগ্রি দেবে।
ঘ) মেডিকেল উচ্চশিক্ষা শুধুমাত্র রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিভাগে মানসম্পন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ঙ) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে উন্নত শিক্ষার প্রয়োজনে, উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়,
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে এটির কাজ কি হবে সেটা আগে ঠিক করতে হবে।যদি উন্নত চিকিৎসা পাওয়া উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর প্রয়োজন নেই।এই কাজটি মেডিকেল কলেজগুলিই করতে পারে। কিন্তু যদি উন্নত শিক্ষার প্রয়োজনে সরকার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে চায় তবে তা করা যেতে পারে।
চ) গবেষণাখাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
ছ) ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যখাতে দূর্নীতির মূলোৎপাটন জরুরি।
জ) দেশের মেডিকেল কলেজগুলোয় মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ খোলার পাসাপাশি উচ্চশিক্ষায় এ বিষয়ে আসন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের করণীয় :
ক] চিকিৎসা শিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে যাতে এর উৎকর্ষ এবং গবেষণা দুটোই গুরুত্ব পায়ঃ
দেশে স্থাপিত চারটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর উভয় শিক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে।চিকিৎসা শিক্ষা হওয়া উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্ত¡শাসিত সংস্থ্ার অধীনে তা নাহলে এর বিকাশ হবে না।
খ) উচ্চশিক্ষার পাঠক্রম পুনর্বিন্যাস করাঃ
(১) এমবিবিএস কোর্সের ফরমেট বা পাঠক্রমের বিন্যাস থেকে এমডি/এমএস এর ফরমেট সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ডেফিসিয়েন্সি থেকে যায় সেটা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীরা যাতে পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারে সেভাবে যেন এমডি/এমএস কোর্সের কারিকুলাম তৈরি করা হয়।
(২) উচ্চশিক্ষার কোর্সগুলো মেডিকেল কলেজে না পড়িয়ে সব শিক্ষার্থীদের বিএসএমএমইউ-তে ভর্তির সুযোগ দিলে সবাই একই রকম সুপারভিশন ও মনিটরিং এর আওতায় থাকবে এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হবার হার বাড়বে।
গ) বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি ধাপে বিভক্ত করা যেতে পারে :
১ম ধাপ : এমবিবিএস পাসের পর ইন্টার্নশীপ শেষ করবে।
২য় ধাপ : প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে জেনারেল বিষয়ে এফসিপিএস পাস করবে।
৩য় ধাপ : ২য় ধাপ পাসকৃতদের মধ্যে যারা চাইবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্পেশালিটি বিষয়গুলোতে নির্ধারিত প্রশিক্ষণ নিয়ে এমডি, এমএস ইত্যাদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বিশেষজ্ঞ হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করবে। তাদের মধ্যে কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকতর গবেষণা কাজে নিয়োজিত থেকে পিএইচডি করতে পারবে।
ঘ) এমবিবিএস পাসের পর সরাসরি আন্তর্জাতিক মানের এমডি,এমএস বা এমফিল করাটাই যুক্তিসংগত :
উল্লিখিত ডিগ্রিসমূহ ইউরোপ আমেরিকা সহ সারা বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি হিসাবে গ্রহণযোগ্য।এ ডিগ্রিগুলো দিয়েই এ দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিপ্লব করা সম্ভব।
ঙ) ইন্ডিয়ান কারিকুলাম আমাদের মতো হলেও তারা ইন্টার্ন থাকার সময়ই এমডি/এমএস-এ এপ্লাই করতে পারেঃ
এমডি করতে ৩ বছরেরও কম সময় লাগে। কম বয়সে বিশেষজ্ঞ হওয়ায় তারা নানা বিষয়ে আরও সূক্ষ জ্ঞান অর্জন করে।আমাদের দেশেও এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
চ) শিক্ষক স্বল্পতার সমাধান করতে হবে।
ছ) উন্নত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ যেমন দেশে নিতে উৎসাহিত করা উচিৎ তেমনি বিদেশে উন্নত শিক্ষা আর প্রযুক্তি শিক্ষা আর সমসাময়িক অগ্রগতির সাথে পরিচিত হওয়া আর শেখা এসব কাজে উৎসাহ দেয়া উচিৎ।
জ) চিকিৎসা মানে ”রোগী দেখা আর চিকিৎসা করা” এই কনসেপ্ট থেকে আমাদের বেরুতে হবে।
ঝ) গবেষণায় আগ্রহী তরুণ ও মেধাবী চিকিৎসকদের উৎসাহ,সহায়তা এবং প্রনোধনা দিতে হবে। মেধাবীদেরকে বছরের পর বছর গ্রামে ফেলে রাখার পদ্ধতি বদলাতে হবে।
ঞ) গবেষণার জন্য ফান্ড সংগ্রহ :
বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসা গবেষণার জন্য নানা উৎসে অর্থ বরাদ্দ আছে।সঠিক আর বিশ্বাসযোগ্য প্রকল্প প্রস্তাবনা লিখতে জানলে অনেক ফান্ড পাওয়া সম্ভব। গবেষণা বিশ্বাসযোগ্য হলে,আন্তর্জাতিক নাম করা জান্র্ােল প্রকাশিত হলে এবং আন্তর্জাতিক অধিবেশনে উপস্থাপিত হলে ফান্ড পাওয়া যায়।
ট] গবেষণাখাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
ঠ] মৌলিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এবং প্যারা ক্লিনিক্যাল সায়েন্সে যারা শিক্ষকতা এবং রোগ নির্ণয়ে নিয়োজিত আছেন তাঁদেরকে গবেষণায় যুক্ত করা যেতে পারে :
যেমন, ক্লিনিকেল বায়োকেমিষ্ট্রি, ল্যাবমেডিসিন, ভাইরোলজি, ইম্যুনলজি, প্যাথলজি, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, মলিকিউলার বায়োলজি, জিনেটিক্স ইত্যাদি। আমাদের দেশে এপিডেমিউলজি, পাবলিক হেলথ, সংক্রামক রোগ বিষয়ে গবেষণায় জোর দেয়া উচিৎ।
ড) গবেষণা, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর উপস্থাপনার উপর অধ্যাপকদের পদোন্নতি হওয়া উচিৎ।
ঢ) মেডিকেল কলেজসমূহের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে কাজ করা।
মেডিকেল কলেজসমূহের করণীয় :
ক) চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক আর কনসালটেন্ট দু রকমের ধারা থাকা উচিৎ।
শিক্ষকরা পড়াবেন,রোগী একাডেমিক প্রয়োজন ছাড়া দেখবেন না।কনসালটেন্টগন রোগী দেখবেন, একাডেমিক প্রয়োজন হলে শিক্ষার্থীদের রোগী চিকিৎসায় ব্যবহারিক জ্ঞানদান করবেন।
খ) একাডেমিক হাসপাতালে কেবল রেফারড রোগী আর জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ রোগী এমন ভাগ থাকা উচিৎ।
গ ) মানসম্পন্ন এমবিবিএস ডাক্তার তৈরি করবে এবং এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়ার পূর্বে যে প্রশিক্ষণ লাগবে সে প্রশিক্ষণ মানসম্পন্নভাবে দেবে।
বিসিপিএস এর করণীয় :
ক) দেশে চিকিৎসা শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বমানের সাথে সমন্বয় সাধন করতে হবে।
খ) এফসিপিএস শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং বিশ্বমান সমন্বয়ের জন্য পাঁচ বছর করাঃ
এ সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি এর মধ্যেই দেয়া হয়েছেঃ” ১৪ অক্টোবর ২০১৯ বিসিপিএস এর অনারারী সচিব অধ্যাপক এ বি এম খুরশীদ আলম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, ২০২০ সালের জানুয়ারি বা তারপরে এফসিপিএস পার্ট-১ পরীক্ষায় পাসকৃত এফসিপিএস ট্রেইনীদের ফেলোশীপ প্রোগ্রামের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক পাঁচ বছর করা হলো(ডাক্তার প্রতিদিন ডট কম,১৬-১০-১৯)।”
ইন্টার্নশীপ শেষ করার পর একজন চিকিৎসক এফসিপিএস পার্ট-১ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। পার্ট-১ পাস করার পর নির্দিষ্ট সময়ের প্রশিক্ষণের পর ২য় পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতদিন এই প্রশিক্ষণ অধিকাংশ বিষয়ের জন্য চার বছর করে বাধ্যতামূলক ছিলো।শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে [ কারডিওলজি, গ্যাসট্রোএনটারলজি, অর্থোপেডিকস, কোলোরেকটাল সার্জারী সহ ব্রাঞ্চের বিষয়গুলোতে ] প্রশিক্ষণ পাঁচ বছর বাধ্যতামূলক ছিলো। এই নোটিশের মাধ্যমে সব বিষয়ে এখন থেকে প্রশিক্ষণ পাঁচ বছর করে চালু হলো।
গ ) বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রাথমিক ধাপ হিসাবে তার প্যারেন্ট সাবজেক্ট এবং কোর ট্রেইনিং এর দায়ীত্ব পালনের ভার বিশ্ববিদ্যালয়কে রেহাই দিয়ে বিসিপিএস নিতে পারেঃ
এ কাজটা বিসিপিএস আগে থেকেই ভালভাবে করে আসছে।
উপসংহার :
এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসেবে উপসংহারে বলতে চাই যে, মেডিকেল শিক্ষার মতো বিশেষায়িত শিক্ষা অবশ্যই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাখতে হবে। তবেই মেডিকেল উচ্চ শিক্ষার সমস্যাসমূহের সমাধানের পথে বাধা থাকবে না বলে মনে করি।

লেখক : চর্ম রোগ ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, প্রাবন্ধিক