মেডলিন মিলারের ‘দি সঙ অব একিলিস’

40

পর্ব : ২
রাজার কাছে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সিংহাসন কক্ষে পৌছতে অনেকদূর হাঁ টতে হয়েছিল আমাকে যা মনে পড়লে ঘৃণা জন্মায় আমার মনে। দূতদের মধ্যে যাদের অনেক কিছু বলার থাকে তাঁদের জন্য কার্পেট বিছিয়ে রাখেন কোন কোন রাজা। অবশ্যই আমার বাবা রাখতেন না। “রাজা টিনদারিছুসের মেয়ে অবশেষে বিয়ের জন প্রস্তুত হয়েছে” তিনি বললেন।
আমি নামটা জানতাম। টিনদারিছুস স্পার্টার রাজা ছিলেন এবং দক্ষিণে বেশকিছু আবাদী জমি ছিল তাঁর যার দিকে আমার বাবার লোভ ছিল । তার মেয়ের কথাও শুনেছিলাম। আমাদের এদিককার দেশগুলোর সবচেয়ে সুন্দর নারী। তার মায়ের নাম লিডা। দেবতাদের ঈশ্বর স্বয়ং জিছুস হাসের বেশে এসে তাকে ধর্ষণ করেছিল। নয় মাস পর তার গর্ভে দুই জোড়া জমজ কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
ক্লাইটেমেনেস্ট্রা ও ক্যাস্তর; হেলেন ও পলিদীছুস। কিন্ত দেবতারা মা বাবা হিসেবে খুবই সঙ্গতিহীন হতেন এবং এটা প্রত্যাশিত ছিলো যে টিন্দারিছুস বাচ্চাগুলোর বাবা হতে রাজি হবেন। আমি বাবার কথার জবাব দিইনি। এ ধরণের ব্যাপারগুলো আমাদের কাছে কোন অর্থ বহন করত না। বাবা জোরে গলা খাকারি দিলেন। “মেয়েটাকে আমাদের পরিবারে আনলে ভালো হবে। তুমি সেখানে গিয়ে নিজেকে পাণিপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরবে।” চেম্বারে আর কেউ ছিল না। আমার হতভম্বিত নিঃশ্বাস বাবার কান ছাড়া আর কারো কাছে পৌছেনি। আমার অসুবিধার কথা আমি জানতাম। আমি কী কী বলতে পারি সেটা বাবা ভালো করে জানতেনঃ আমার বয়স নয় বছর, চোখে পড়ার মতো না, অনাগ্রহী ও অনিচ্ছুক।
পরদিন সকালে আমরা রওনা হলাম। পথে খাওয়ার জন্য যথেষ্ট খাবার দাবার ও ব্যাগভর্তি উপহার সামগ্রী নিলাম। আমাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সুসজ্জিত সৈনিকদল। যাত্রা সম্পর্কে আমি এর বেশিকিছু মনে করতে পারছি না যাত্রাপথ মোটেও উপভোগ্য ছিল না। লাইনের সবার আগে ছিলেন বাবা। সচিবদেরকে নতুন করে আদেশ ছিলেন। নিচু হয়ে চামড়ার তৈরি লাগামের দিকে তাকালাম এবং বুড় আঙুল দিয়ে তাদের রোয়াগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলাম।। আমি আমার অবস্থান বুঝতে পারছিলাম না । বাবার আচরণের মতো এটা ছিল আমার বোঝার সাধ্যাতীত। আমার গাধাটি ইতস্তত চলাচল করছিল সাথে আমিও। টিন্দারিছুসের দুর্গে আমরা একমাত্র পাণিপ্রার্থীর দল ছিলাম না।
আস্তাবল্গুলো ঘোড়া ও খচ্চরে ভরা। চাকরেরা এগুলোর দেখভালো করার কাজে ব্যস্ত ছিল। বাবাকে সামগ্রিকভাবে অসন্তুষ্ট মনে হল। আমাদের যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল সেখানে একটা পাথরে তাঁকে রাগে গজর গজর করতে করতে হাত ঘষতে দেখেছিলাম। বাড়ি থেকে আমি একটা খেলনা ঘোড়া এনেছিলাম যার একটা পা চলতে পারে। আমি ঘোড়াটাকে নেড়েচেড়ে নিজেকে বুঝ দিচ্ছিলাম গাধার পরিবর্তে যেন আমি ঘোড়াটার উপরে চড়ছিলাম। একজন সৈনিক আমার উপর করুণা দেখিয়ে তার ছক্কাদানিটা ধার দিল। আমি ওগুলোকে মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে খেলতে লাগলাম।
অবশেষে একদিন বাবা আমাকে স্নান করে প্রস্তুত হতে বললেন। তিনি আমার কোট বারবার পরিবর্তন করালেন। যদিও আমি বেগুনী রংয়ের সাথে সোনালী অথবা গাঢ় লালের সাথে সোনালী রংয়ের কোন পার্থক্য দেখি না। এর কোনটাই আমার ফুলে থাকা হাটুজোড়া ঢাকতে পারেনি। বাবাকে দেখতে খুব ক্ষমতাশালী ও কড়া দেখাচ্ছিল। টিন্দারিছুসের জন্য আনা উপহারটা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্বর্ণের তৈরি একটা পাত্র যাতে রাজকন্যা ডানার গল্প খোদাই করা। জিউস তাকে আলোর ঝলকানিতে প্রেম নিবেদন করেছিলেন এবং তার ঔরসে পারসিউসের জন্ম হয়। গর্গনদের হত্যাকারী এবং হেরাক্লিস এর পর আমাদের দ্বিতীয় বীর। বাবা আমার হাতে উপহারটি দিলেন। “আমাদের অপমান করো না” তিনি বললেন।
সামনাসামনি দেখার আগে বড় হল ঘরটাতে হাজার হাজার লোকের আওয়াজ শুনেছিলাম। চাকরেরা জানালার কপাট খুলে দিয়েছিল আওয়াজের মাত্রা কমাতে। প্রত্যেকটা দেয়ালে নকশাখচিত পর্দা ঝোলানো। আমি এর আগে কখনো এত মানুষ একসাথে দেখিনি। মানুষ না , নিজেকে শুধরে নিলাম পরক্ষণে।
রাজা।
আমাদেরকে কাউন্সিলের কাছে ডেকে পাঠানো হল। গোচর্ম দিয়ে ঢাকা বেঞ্চে বসতে বলা হল। চাকররা সবাই পেছন দিক থেকে সরে গেল। বাবা আমার শার্টের কলার চেপে ধরে সতর্ক করলেন আমি যাতে
অস্থিরভাবে নড়াচড়া না করি।
ঐ ঘরটাতে সংঘর্ষ চলছিল। অনেক অনেক রাজা, যুবরাজ ও বীর প্রতিযোগিতা করছিল একটামাত্র পুরস্কারের জন্য। কিন্তু আমরা জানতাম কিভাবে সভ্যতার ভান করা যায়। দামী পোশাক পরিহিত, উজ্জ্বল চুলওয়ালা যুবকগুলো একে একে নিজেদের নাম পরিচয় দিতে লাগল। এদের অনেকে ছিল আবার দেব-দেবতার সন্তান অথবা নাতি। প্রায় সবার দলিলে একটা বা দুটো করে গান লেখা আছে। টিন্ডারিছুস একে একে সবাইকে অভিবাদন জানালেন এবং তাঁদের প্রদত্ত উপহার সামগ্রী ঘরের মাঝখানে জড় করে রাখলেন। একজন করে বক্তব্য প্রদান করে নিজের আর্জি পেশ করার আমন্ত্রণ জানালেন।
ফিলোক্টেটস নামের একজন ছাড়া উপস্থিত সকলের বয়োজৈষ্ঠ ছিলেন আমার বাবা। আমাদের পাশে দাঁড়ানো একজনকে বিস্ময়ের সংগে বলতে শুনলাম, “হেরাক্লিসের একজন”। হেরাক্লিস আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর চজিলেন এবং ফিলোক্টেটসতাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। হেরাক্লিসের সহচরদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি ইনি। পাকা চুলের এই বয়স্ক ব্যক্তি কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর ধ্নুকটি দেখিয়ে বললেন এটা হেরাক্লিসের । মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে ধ্নুককে কাপুরুষত্বের চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এখানে কেউ এ ধরণের কিছু বলেননি।
পরেরজন, যার চোখগুলো মহিলাদের মতো দেখতে, নিজের নাম বলে পরিচয় দিলেন। “ইডোমেনিছুস”, ক্রিটের রাজা। “রোগাপাতলা একজন মানুষ তিনি। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল । দুর্ল্ভ লোহার তৈরি দ্বিমাথা বিশিষ্ট একটা কুড়াল উপস্থাপন করলেন তিনি। “আমার প্রজাদের প্রতীক।” তাঁর চালচলন দেখে আমার মায়ের প্রিয় নাচশিল্পীর কথা মনে পড়ল।
এবং তারপর আর্টিউসের সন্তান মেনেলাস তাঁর ভাই আগামেমননের পাশে বসা। মেনেনাসের চুলগুলো দেখতে বিস্ময়কর রকমের লাল ছিল, আগুনে পেটানো ব্রোঞ্জের রং। শারিরীকভাবে শক্তিশালী ছিলেন তিনি। তিনি যে উপহারটা এনেছিলেন সেটা বেশ দামি ছিল। সুন্দর একটা কাপড়। “রাজকন্যার সাজের দরকার নেই যদিও” তিনি হেসেহেসে বললেন । এ বক্তব্যটা সুন্দর ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল সুন্দর কিছু বলব। আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সী মানে বিশ বছরের নিচে এবং একমাত্র আমি দেবতার বংশধর কেউ ছিলাম নয়া। আমি মনেমনে ভাবলাম পেলিছুসের স্বর্ণাভকেশী সন্তানই এর যোগ্য পাত্র। কিন্ত তার বাবা তাকে নিয়ে আসেননি।