মেজবানের সুলুক সন্ধানে

6

মুশফিক হোসাইন

চট্টগ্রামের রন্ধন সংস্কৃতির মধ্যে যে আয়োজন বা রান্না সবচেয়ে বেশি খ্যাতি ও ব্যাপ্তি পেয়েছে তা হলো মেজবান বা মেজ্জানের রান্না। কর্ণফুলী অববাহিকতার সমগ্র অঞ্চল তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের মেজ্জানের জুড়ি নেই। হালে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদেরও মন জয় করেছে। সামাজিক মাধ্যমে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কোন কোন দেশে মেজবান অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনেকের ধারণা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও ইতিহাস খ্যাত মেজবানীর প্রচলন মোঘল আমলে। বস্তুতঃ এটি একটি ভুল ধারণা। তবে এ কথাও সত্য যে, কখন মেজবানী প্রথম চালু হয়েছিল তার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। এই জনপ্রিয় সামাজিক অনুষ্ঠান এবং খাদ্য ভোজনরসের প্রথা সামাজিক গÐি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও কর্পোরেট সংস্কৃত বা কালচারে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে। বলা যায়, বহাল তবিয়তে প্রসারমান। বলাবাহুল্য চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে এবং বিদেশে প্রসারতা লাভ করেছে চাটগাঁইয়া জনগোষ্ঠির মাধ্যমে। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, চাটগাঁইয়াদের ব্র্যান্ড হচ্ছে ‘মেজবান’।
ইতিহাসের তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করে এর নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। তারও আগে ১৫২৬ সালে পানি পথের যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারত সা¤্রাজ্য বিস্তার করে। এই মোঘলরা এশিয়ার টার্কোমঙ্গল বংশভুত। পিতার দিক দিয়ে পারশিয়ান চাগতাই খান এবং মাতার দিক দিয়ে ‘মঙ্গল’ বংশভুত তৈমুর উত্তরসূরী। তুর্কি ও ইরানের রক্ত তাদের মধ্যে প্রবাহিত। তবে মোঘল হেরেমের বেগমদের অধিকাংশই ছিলেন অমুসলিম। সঙ্গত কারণে তাদের হেরেমের রঁসুইঘরে গো-মাংসের তেমন প্রচলন ছিল না। বড় বেশি হলে বটি কাবাব, জালি কাবাব ও শিক কাবাব পর্যন্ত। বরঞ্চ কাচ্চি বিরানি, মোরগ পোলাও, কোস্তা, ফিরনি, ফালুদা, ফলের শরবত এবং দারুর প্রচলন বেশি বলে জানা যায়। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) এর রাজত্ব কালে বিজয়গুপ্তের (১৫০০-১৬০০খৃ.) কাব্যগ্রন্থ পদ্মাপুরান প্রকাশ হয়। পনের শতকের কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় প্রথম মেজবান (আপ্যায়ন) এবং মেজোয়ানী (আপ্যায়নকারীর) তথ্য পাওয়া যায়। সুলতান আলাউদ্দিন শাহের সময় এতদঞ্চলে ফার্সি ভাষার ব্যবহার বা প্রচলন ছিল। মেজবান শব্দটি ফার্সি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে আপ্যায়ন। চট্টগ্রামে আরব বণিকদের আগমন ৬১০ খ্রিস্টাব্দ। তাদের পথ অনুসরণ করে ১৪০০-১৫০০ শতকে তুর্কি ও ইরান থেকে বণিক ও পর্যটকগণ এদেশে আসতে থাকে। অতএব পনের শতকে কবি শাহ বারিদ খানের কবিতাকে ভিত্তি করে বলা যায় পনের শত শতকে তুর্কি ও ইরানীদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজবানের প্রচলন শুরু হয়। তারা তাদের খাদ্য সংস্কৃতির সাথে চট্টগ্রামের সহজলভ্য আরসিসি বা চঁটগাঁইয়া লাল গরুর মাংসের উপাদানে খাদ্য সংস্কৃতি প্রচলন করে। যেহেতু চট্টগ্রাম বন্দর হাজার বছর ধরে প্রসিদ্ধ। সেহেতু আরব তুর্কি ও ইরানি মুসলিম বণিকদের যাতায়াত বেশি ছিল। পুর্তগীজ ধর্মযাজক সেবাস্টিনের মতে, তখন চট্টগ্রাম মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান এলাকা ছিল।
বণিক এবং স্থানীয় মুসলমান ও মেজবানের প্রধান উপকরণ চাটগাঁইয়া লাল গরুর সহজলভ্যতা প্রধান সমন্বয়ক হিসাবে ভূমিকা রাখে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, চাটগাঁইয়া লাল গরুর প্রধান বৈশিষ্ট হল এর মাংস নরম ও সুস্বাধু। উপরুক্ত এই প্রজাতির গরু এতদঞ্চলের পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে টিকে আছে। এ ছাড়াও এর রঙের কারণে মেজবান দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এই সকল বাস্তব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসা যায় ১৫০০ শতকের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময় থেকে মেজবানের প্রছলেন শুরু হয়।
চাটগাঁইয়া যেমন ভোজনরসিক তেমনি তাদের আপ্যায়নেরও সুনাম আছে। ফলতঃ মেজবান সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। মেজবান চাটগাঁইয়াদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এক সঙ্গে কয়েক শতাধিক লোককে আপ্যায়ন করার জন্য প্রচুর অর্থ তথা সামর্থ্যরে প্রয়োজন। ঐতিহাসিক কাল থেকে চাটগাঁইয়ারা ব্যবসা বাণিজ্যে অগ্রগামী। স্বভাবতই তারা সামর্থ্যবান ছিলেন এবং আছেন। এই সামর্থ্য ও চাটগাঁইয়া লাল গরুর লভ্যতা ও মাংসের গুনে এদতঞ্চলে দ্রæত প্রসার করে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তুর্কি ও ইরানি বণিকেরা। তাদের খাদ্য রুচির সাথে মিলেমিশে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মেজবান সংস্কৃতির উদ্ভব ও প্রসার।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)