মেজবানের সুলুক সন্ধানে

34

মুশফিক হোসাইন

দ্বিতীয় পর্ব : প্রাচীনকালে মেজবান ছিল গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্য। মৃত্যুকে উপলক্ষ করে চারদিন/চল্লিশায় গ্রামবাসী, পাড়া প্রতিবেশি এবং আত্মীয় স্বজনদের ভোজনে আপ্যায়ন করা হয় মেজবানে। মূল উপাদন ছিল সাদা ভাত ও গো-মাংসের রেজালা। হালে জন্মবার্ষিকী, বিয়ে শাদী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মেজবানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এর সাথে রাজনৈতিক প্রথা ও যুক্ত হয়। যা রজনৈতিক সমর্থদের উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয়। তবে মেজবানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মৃতদের আত্মার সওয়াব রেসানি। পুর্ণার্থে এই মেজবান আয়োজনের ভিত্তি হলেও তা হালে রাজনীতি ও ব্যবসায়িক স্বার্থে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি মেজবান চালু করে। চট্টগ্রামের সন্তান খ্যাতিমান ডা. নুরুল ইসলাম এর উদ্যোক্তা ছিলেন।
পরবর্তীতে চট্টগ্রামের প্রাক্তন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৫ই আগস্টকে উপলক্ষ করে টুঙ্গিপাড়ায় মেজবান আয়োজন করেন। কালক্রমে তা বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায় সম্প্রসারিত হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর চল্লিশায় ১২টি কমিউনিস্টি সেন্টাওে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জন্য মেজবান আয়োজন করা হয়। অন্য ধর্মাবম্বলীদের জন্য চারটি কম্যুনিটি হলে ছাগলের মাংসের আয়োজন করা হয়েছিল। মেজবানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য ছাগলের মাঅংস, মোরগ বা মাছের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি মেজবানের গ্রামীণ ঐতিহ্য হচ্ছে, মেজবানের আগের দিন রাতে বা সুবিধাজনক সময়ে ১পানসল্লা’র বৈঠক আয়োজন করা হয়। বর্ণিত বৈঠকে চা নাস্তা, সরবত, পান, তামাক হুকো ইত্যাদির আয়োজন থাকে। বৈঠকে সমাজের মাতব্বর, সর্দার ও গণ্যমান্য লোকজন বসে মেজবান পরিচালনা বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। মেজবান প্রায়শ সকালে আয়োজন করা হতো। তবে রাতে হলে হ্যাজাক বাতির ব্যবস্থা করা হয়। হালে বৈদ্যুতিক বাতি বা জেনারেটর ব্যবহার হচ্ছে। লম্বা চাটাই বিছিয়ে দেয়া হতো, অতিথিরা দুই সারিতে কাতার হয়ে বসে পরিবেশিত খাওয়ান খান। সানকিতে সাদাভাত ও গরু/মহিষের মাংস পরিবেশ করা য়। সাথে থাকে নলার ক্বাজী/সুরুয়া বা মাষকলাইয়ের ডাল। কেউ কেউ আবার ছোলার ডাল ও বাংলা কদু সহযোগে একটি ব্যঞ্জন রান্না করে থাকেন। মেজবানের সাঅংসে ২২ পদেও মসল্লা ও কাঁচা লংকা ব্যবহার হয়। মেজবানের রান্নার জন্য অভিজ্ঞ বাবুর্চি চাই। সকল বাবুর্চি মেজবানের রান্না করতে সক্ষম নয়। মাংসে হাটহাজারীর লাল মিষ্টি মরিচ ব্যবহার অবশ্যই চাই। এতে ব্যঞ্জনের রং হবে লাল, তবে ঝাল কম হবে। খাওয়ার পরিবেশনের ছড়িয়ে পড়ে। পানি পান করানোর জন্য মাটির কক্তি বা বদনা ব্যবহার করা হয়। হালে জগ গøাসের ব্যবহার বেড়েছে। এলম্যুনিয়ম ও প্লাস্টিক আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি অনেকখানি বদলে দিয়েছে। চাটাইয়ের পরিবর্তে চেয়ার টেবিল, বয় বেয়ারা আবির্ভাব ঘটেছে। এখন মাঠে ময়দানে উঠোনে মেজবান অনুষ্ঠান নেই বললেই চলে। মেজবান অনুষ্ঠিত হয় ক্লাব ও কমিটিউটি সেন্টারে। গ্রামীণ মেজবানে উচ্ছিষ্ট কোন স্থানে ফেলে দেয়া হত। এতে করে কুকুর বিড়াল, শিয়াল, কাক, চিল ইত্যাদি প্রাণীরা খেয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতো। বর্তমানে ক্লাব/কমিউনিটি সেন্টারের উচ্ছিষ্ট খাদ্য এক শ্রেণির লোকজন সস্তায় কিনে নিয়ে ‘কাউয়া বিরানি’ হিসাবে শহর এলাকার স্বল্প আয়ের লোকজনের কাছে বিক্রি করে থাকে। ফুটপাতে বসে এই খাওয়ার বিক্রির হতে দেখা যায়। হাঁড়গোড় কেজি হিসাবে চলে যায় ভাঙারির দোকানে। সর্বশেষ মেজবানের সামাজিক ঐতিহ্যের ভিত এবং রাজনৈতিক স্বার্থের সাঁকো পেরিয়ে বাণিজ্য ল²ীর হাত ছুঁয়েছে। ‘মেজ্জান খাইলে আঁইয়ুন’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দিতে পা রেখে জম মাট ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রামের বাইরের কেউ বেড়াতে এলে এ ধরনের হোটেলগুলোতে খাওয়ার রীতি শুরু হয়েছে। এক সময় চট্টগ্রামের বাইরের লোকজনের কাছে ‘ফিরিঙ্গীবাজারের বার্মা রাজু’ হোটেলের নাম প্রসিদ্ধ ছিল। হালে মেজবানের খাবারের সপগুলোর প্রসিদ্ধি অনেক অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে রমজানে ইফতার বিক্রির সময় মেজবানের মাংস বিক্রির প্রবণতা বেশ লক্ষনীয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রচুর ভারতীয় গরু মহিষ আমদানি হত। বিশেষ করে ভারতের বড় সাজের গরু মহিষগুলো মেজবানে জবাই হতো। ভারত সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বরঞ্চ বাংলাদেশেরই লাভ হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যমী খামারিদের পরিশ্রমে বাংলাদেশ গরু মহিষ ছাগল উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের কোরবানি হাটে ১ কোটি ২২ লাখ পশু বিক্রির জন্য উঠে। বিক্রি হয় প্রায় ১ কোটি এবং ২২ লাখ পশু উদ্বৃত্ত থেকে যায়। তবে আরসিসি বা চাটগাঁইয়া লাল গরু মেজবান সারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। সেই লাখ গরু তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। এই গরুর জাত ও চরিত্র কাম্য পর্যায়ে রাখার জন্য উপযুক্ত গবেষণা যেমন নেই তেমনি এর জিনম সিকোয়েন্স করে চরিত্র নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে সংরক্ষণ পদ্ধতির দুর্বলতার কারণে তারা শঙ্করায়নের স্বীকার হচ্ছে। চাটগাঁইয়া লাল গরু মাংসে মেজবান রান্নার যে স্বাদ অন্য প্রজাতির গরুতে সে বৈশিষ্ট্য শতভাগ পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামের সামাজিক রন্ধন সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেজবানের স্বকীয়তা রক্ষার স্বার্থে পশু যেমন বিবেচ্য তেমনি বাবুর্চিদের প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা জরুরি। কর্ণফুলী অববাহিকার এই ঐতিহ্যবাহী মেজবান প্রায় পনের শত বছরের। তার স্বকীয়তা এবং সামাজিক আবেদন পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ ও গবেষকদের এগিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যকরণের চাপে তার স্বকীয় হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)