মেঘমেদুর বরষায় নজরুলের গান

346

 

যে কবির গানের বিশাল সম্ভারে বরষা, প্রিয়া-বিরহ এক অনন্য রূপে বারবার উঠে এসেছে, তিনি কবি নজরুল। কবি সত্ত্বাতে বর্ষা-বাদল আষাঢ়-শ্রাবণে মেঘলা আকাশে সঞ্চারণশীল গভীরকালো মেঘমালার মতোই ব্যাপ্ত। কাজী নজরুল ইসলামের গানে তা আরো ব্যাপ্ত। নজরুলের ব্যক্তি জীবনের ছন্নছাড়া অবস্থা তাঁর রচনা সংরক্ষণের বেলাতেও দেখা যায়। অনেক গানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা হলো- কথা কাজী নজরুলের কিন্তু সুরটা অন্যে দিয়েছেন। এভাবেই অনেক গান বিক্ষিপ্ত রয়ে গেছে রচনার সময় থেকেই। ফলে কাজী নজরুলের গানগুলোর পর্যায় ভাগ কবি দেখে যেতে পারেননি, যেমন দেখে যেতে পারেননি তাঁর রচনা গানের পাহাড় সমান জনপ্রিয়তা। নজরুল ইসলামের সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় বিশেষত কবিতায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব, কিন্তু গানে তাঁর ঝর্ণাধারার মতো অবিরাম ছন্দে তাক লাগানো প্রতিভা দেখিয়েছন- যা বাংলা গানে অতুল।
নজরুলের গানের বিশাল সম্ভারে বরষা, প্রিয়া-বিরহ যেন এক অভিন্ন রূপে বারবার উঠে এসেছে। সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় এর স্বরূপ তুলে ধরা সম্ভব নয়। নজরুল ইসলামের গানে বর্ষা,বাদল, প্রিয়া-বিরহ বিশেষ এক আধিপত্য বিস্তার করে আছে, একাকার হয়ে আছে। এ বিষয়ক অল্প বিস্তর আলোচনার চেষ্টা করছি। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘বর্ষা ঋতু, আষাঢ় এবং শ্রাবণ মাস নিয়ে নজরুলের প্রায় দেড় শতাধিক গান রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেণি-বিভাজন রয়েছে, যেমন, কাজরী ২৩, কাব্য-গীতি ৪১, রাগপ্রধান ২৪, খেয়াল ২৫, ঠুমরি ২, আধুনিক ২৯, ঝুলন ৪, চৈতী ৩ এবং ৪ খানি হিন্দি গান। পুরো বর্ষাঋতুর দেড় শতাধিক গানের মধ্যে শ্রাবণ মাস নিয়েই রয়েছে নজরুলের অনবদ্য ষাটটি গান।’ (ড. মাহফুজ পারভেজ)।
তার গানে প্রিয়ার বেদনার গভীরতা ফুটে উঠে বর্ষা প্রকৃতিতে-
‘আমার প্রিয়ার দীর্ঘ নিঃশ্বাসে,
থির হয়ে আছে মেঘ যে দেশের আকাশে।’
‘মেঘ-ঘন-কুন্তলা’ বা ‘কাঁখে বরষা-জলের ঘাগরি’
‘এলায়ে মেঘ-বেণী,
কাল-ফণী,
আসিল কি দেব কুমারী’
– এই ছোট ছোট উপমায় প্রিয়ার রূপ একাকার।
প্রিয়াকে খুঁজতে গিয়েছেন- ‘কত বরষায় খুঁজেছি তোমায়, তারায় তারায়।’
এমন কি কবির ‘আপনার চেয়ে আপন যেজন’ তাঁরে ও পেতে চেয়েছেন এ ভাবে- ‘স্নেহ মেঘশ্যাম অশনি আলোতে হেরি তারে থির বিজুলি উজল অবিরাম।’
ঝিলের ধারে কোন এক পল্লী বালিকা তাঁর বর্ণনায় এরকম-
‘কাজল বরণ পল্লী মেয়ে,
বৃষ্টি ধারায় বেড়ায় নেয়ে..
মেঘের পানে চেয়ে একেলা,
মেঘলা সকাল বেলা।’
আবারো প্রিয়ার খুঁজে পরদেশী মেঘ। এবার কেয়া পাতে নয়;বরং সরাসরি মেঘকেই প্রিয়াকে বলতে অনুরোধ করেছেন-
‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে,
বলিও আমার পরদেশীরে।
সে দেশে যবে বাদল ঝরে,
কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে
বাদল রাতে ডাকিলে পিয়া…
উঠে নাকি ..হিয়া।”
একটি জনপ্রিয় গান,
‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।”
গানটি নিয়ে যুগে যুগে উভয় বাংলায় বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের কাহিনীতে বরষা, বিরহ, প্রেমের অতলান্তিক আবহ তৈরি করা হয়েছে। জনপ্রিয় সব শিল্পিই এ গানে কন্ঠ দিয়ে আরো বিখ্যাত হয়েছেন।
‘ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে,
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে,
যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে।”
এখানে গহন বন, একেলা বাতায়ন, কুহু কেকা, নীপ শাখে ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারে প্রেম-প্রিয়া-বিরহ আর বর্ষার এক গভীর ব্যঞ্জনা তৈরিকরা হয়েছে।
‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর,
শ্রাবণ মেঘে নাচে নটবর…’
এ গানেও চুপিচুপি প্রিয়া দরশনে শ্রাবণ-মেঘের আবহকে ডেকে এনেছেন কবি।
‘শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না,
বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না।
কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুজিয়া,
সেকি ফেরার পথ পেল না মা পেল না “কিংবা
“বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া,
নামিল মেঘলা মোর ভাদরিয়া,
চল তমাল তলে গাহি কাজরিয়া,
চললো গৌরী শ্যামলিয়া”
– এখানে যে প্রিয়জনকে বর্ষায় কাছে পাওয়ার আকুতি প্রকাশ; সে এল না, আবার পাওয়ার আশাও রয়ে গেল।
আবার ‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ,
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’
এখানে বর্ষা, প্রিয়া আর বিরহের এক অদৃশ্য সম্পর্ক স্পষ্ট।
‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া,
ফুটাইয়া যূঁথি-কুন্দ-নীপ-কেয়া,
বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে,
বিরহী মনে জ্বালায়ে আশা আলেয়া’
– যেখানে বর্ষাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আহব্বান করেছেন।
অন্য কথায়- “ওগো মেঘ তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহ,
বন্দিনী- গিরি ঝরনা পাষাণ তলে যে কথা কহিতে চায়।”
‘কেমনে রাখি আঁখি বারি …,
এ ভরা ভাদরে আমারই মরা নদী
উথলি উথলি উঠিছে নিরবধি।’
– ভাদরের বরিষণে তাঁর ঘুমন্ত প্রেম জেগে ওঠার ইঙ্গিত বহন করে।
“আমি যার বরষার আনন্দ কেকা”
এতে মহিয়ান সুন্দরকেও কবি বরষার মাঝেই খুঁজে নিতে চান।
তাঁর প্রিয়াকে পত্র পাঠাবেন বরষার কেয়া পাতে, তাও আবার বয়ে নিয়ে যাবে মেঘদূত।
“যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে,
লেখা কেয়া পাতে,
বরষার ফুলদল বেদনায়
মূর্চ্ছিয়া আছে আঙিনাতে।”
এতে প্রিয়া আর বরষা এক অভিন্ন অস্তিত্বে মিশে আছে করুণ বিরহ রাগে। কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার শ্রাবণকে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন আরব-মরুতে।’ নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল’- এই নাত-ই-রাসুলটির তৃতীয় বা শেষ অন্তরাতে ‘শ্রাবণ’কে এভাবে বাণীতে যুক্ত করেছেন নজরুল: ‘যে নাম বাজে মরু-সাহারায়/যে নাম বাজে শ্রাবণ-ধারায়।’
কবি নজরুল ইসলাম গানের সংখ্যার বিচারে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে। তার হাজার কয়েক গানে ঋতু ভিত্তিক গানের সংখ্যা কত- বলা মুশকিল। তবে বরষা ঋতু কেন্দ্রিক গানের সংখ্যাই অধিক হবে তা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ ছাড়াই বলা যায়।
এখানে কবির বর্ষা পর্যায়ে বিশাল সম্ভারের কিছু গানের সূচনা পঙকতিটি তুলে ধরছিঃ
থৈ থৈ জলে ডুবে গেছে পথ এসো এসো পথ ভুলা
গগনে সঘনে চমকিয়ে দামিনী মেঘ ঘনরসে রিনিঝিনি বরষে
আজি আষাঢ়ের বজ্র-গর্ভ নবীন নীরদ-সম
আজি বাদল বঁধু এলে শ্রাবণ সাঁঝে
ঝরঝর ঝরে শাওন ধারা
মেঘ মেদুর গগন কাঁদে হুতাশ পবন
আজ বাদল ঝরে একলা ঘরে
মেঘে মেঘে অন্ধ অসীম আকাশ
অম্বরে মেঘ মৃদংগ বাজে
দুলবি কে আয় মেঘের দোলায়
বাজে মৃদঙ্গ বরষার
রুমঝুম ঝুম বাদল নুপুর বাজে
অঝর ধারায় বর্ষা ঝরে
গগনে সঘনে চমকিছে
আবার কী এলোরে বাদল
মেঘলা নিশি ভোরে মন যে কেমন করে
আজ শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে
গগনে খেলায় সাপ বরষা-বেদিনী
নিশি ভোরে অশান্ত ধারায় ঝর ঝর বারি ঝরে
গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু
ঝরে ঝর ঝর কোন গভীর
ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে
ঝরিছে অঝোর বরষার বারি
এসো স্নিগ্ধ-শ্যাম-বেনী-বর্ণা-মালবিকা
কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের বাঁশি
ঘোর ঘনঘটা ছাইল গগন
চঞ্চল শ্যামল এলো গগনে
বরষা ঋতু এলো এলো
মেঘের হিন্দোল দেয় পূর্ব হাওয়াতে দোলা
তরুণ অশান্ত কে বিরহী নিবিড় তমসায় ঘনফের বরষায়
কার ঝরঝর বর্ষণ বাণী যায় দিক্ দিগন্তে বেদনা হানি
ঝরে বারি ঝুরুঝুরু জাগি একা ভয়ে নিদ নাহি আসে,
বাদল-মেঘের মাদল তালে
এ ঘোর শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে
আজ নতুন করে পড়ল মনে মনের মতনে
আবার শ্রাবণ এলো ফিরে তেমনি ময়ূর ডাকে
আজ শ্রাবণের লঘু মেঘের সাথে মন চলে মোর ভেসে,
নিশিরাতে রিমঝিম্ ঝিম বাদল নূপুর
বরষা ঐ এলো বরষা
আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।
আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
জনম জনম গেল আসা পথ চাহি
বাদল ঝরঝর আসিল ভাদর বহিছে তরল তার পূবালী পবন
বাদল রাতে মোর নিভিয়া গিয়াছে বাতি-
আজি এ বাদল দিনে কত কথা মনে পড়ে
তুমি বর্ষায় ঝরা চম্বা তুমি যূথিকা অশ্রæমতী
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে
রিমিঝিম রিমিঝিম ঐ নামিল দেয়া
বরষার নব ধারা ছন্দে এলে বন মুকুলের গন্ধে
মাদল বাজিয়ে এলো বাদল মেঘ এলোমেলো
মেঘের ডমরু ঘন বাজে – ইত্যাদি।
নজরুলের একটি গানে বরষায় প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুতি। যেমন করে প্রিয়জনের আকুলতায় বরষায় ফুল ছড়িয়ে বনভূমি কাঁদে, বারিধারা ঝুরে, নদী কাঁদে তার তট চুমি, আমরাও এই মহান গানের চাতক কিংবা চকার তৃষ্ণা কাতর এক নিবেদন দিয়ে আপাতত শেষ করছি।
‘মেঘ মেদুর বরষায়,
কোথা তুমি,
ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি।
ঝুরে বারিধারা ,
ফিরে এসো পথহারা ,
কাঁদে নদী তট চুমি।’