মৃত্যুর ফাঁদ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক বেপরোয়া গাড়ির গতি থামাবে কে ?

27

 

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন মরণ ফাঁদে পরিনত হয়েছে। হিসেব করলে দেখা যাবে, এমন কোন দিন নেই যে, এ মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে না, কয়েক জনের প্রাণ সংহার হচ্ছে না। মাসাধিক আগে কাকডাকা ভোরে একটি বেপরোয়া পিকাপ চকরিয়া এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচভাইয়ের ওপর গাড়ি তুলে দিয়ে যে নির্মম হত্যাকান্ড চালায়, গত সোমবার আরো একবার এ হত্যাকান্ডের পুনরাবৃত্ত ঘঠনা লোহাগাড়া এলাকায়। এবার ভোরে একটি কারে করে পাঁচবন্ধু কক্সবাজার যাওয়ার পথে লোহাগাড়া আধুনগর স্টেশন এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী পণ্যবোঝাই ট্রাক কারটিকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই চার বন্ধু নিহত হন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর আরো একজন মৃত্যুবরণ করেন। নিহত একজন চালক, বাকি সবাই বন্ধু। বয়স ২৫ বা ২৬ বছর। এবয়সের তরুণ মানেই স্বপ্নবানে ভাসা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। সমবয়সী পাঁচটি তরতাজা প্রাণর শবযাত্রা আমাদের ব্যাকুল করে, মর্মেমর্মে আঘাত করে। আর এ তরুণদের যারা জন্ম দিয়েছেন, কোলেপিঠে বড় করেছেন, পরমমমতায় স্বপ্নের আলপনা এঁকেছেন, সেসব মাবাবা বা পরমাত্মীয়ের বেদনার অশ্রæধারা কে বন্ধ করবে? মহামহিম স্রষ্টাই তাদের একমাত্র সাহায্যকারী-আমাদের এ প্রত্যাশা বৈ আর কিছুই নেই। চকরিয়ার দুর্ঘটনার পর সম্পাদকীয় স্তবকে আমরা বলেছি, সড়ক দুর্ঘটনা, এখন আর নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি ‘মহামারি’ আকার ধারণ করেছে । একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর থাকছে। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও অনেক। এ সব দুর্ঘটনায় পুরো দেশই যেন শোকাহত হয়ে পড়েছে। যুগপৎ বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ। ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় পরপর কয়েকজন শিক্ষার্থীও মৃত্যুর ঘটনায় সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের আন্দোলন সফলও হয়েছিল, এসময় সরকার নিরাপদ সড়ক আইন প্রণয়ন করে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুও ঘটনারোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এ আইনের সুফল জনগণ পাবে। সড়কে থামবে মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু ‘যে লাউ সেই কদু’ আইনের কঠোর বিধান লম্বা হয়েছে বটে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ হয়নি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টানতে হবে, দুর্ঘটনারোধে প্রয়োজনীয় আরো কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে। কোন কোন দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করে তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৭ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৯ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গতকারণেই এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। এটি একটি বড় সংকট; সঙ্গতকারণেই এই সংকট থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।’ দুর্ঘটনার কারণগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলেই কমবেশি জানেন। এর মধ্যে রয়েছে- দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর লাইসেন্সবিহীন দক্ষতা-অভিজ্ঞতাহীন চালক সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। উপরন্তু সড়ক ও মহাসড়কগুলোর নির্মাণে রয়েছে ত্রুটি। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়শই সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। স¤প্রতি দুর্ঘটনা মহামারির আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ি করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। লোহাগাড়া, চকরিয়াসহ নানা জায়গায় সংঘটিত দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ এটিই। তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে ভোরে বা সকালের দুর্ঘটনা নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ আছে, যা প্রণিধানযোগ্য। এটি হল, এ সড়ক দিয়ে সরারাত শতশত লবণের গাড়ি যাতায়াত করে, ফলে লবণের লবে পানি সড়কে পরার পর সড়ক পিচ্ছিল হয়ে উঠে। এতে সাধারণ গাড়ি বা হালকা যানের গাড়ির গতিরোধ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। একারণে ভোরে এ সড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। এ পর্যবেক্ষণ একেবারে তুচ্ছ করার মত নয়। বলা যায়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সড়ক সংশ্লিষ্টদের আমলে নেয়া জরুরি।