মৃত্যুদন্ডকে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে বহাল রাখা না রাখা প্রসঙ্গে

181

জিয়া হাবীব আহসান

সমগ্র দুনিয়াজুড়ে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা না রাখা প্রসঙ্গে একটি উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ বলছেন, অপরাধ নির্মূলে দৃষ্ঠান্ত মূলক সাজা হিসেবে এটা বহাল রাখা উচিৎ, আবার কেউ কেউ বলছেন শান্তি দিয়ে অপরাধ প্রবণতা নির্মূল করা যায় না,তাই এটা পরিহার করা উচিৎ। আইনের দৃষ্টিভংগী হচ্ছে প্রয়োজনে ১০ জন অপরাধী মুক্তি পাবে তবুও যেন একজন নিরপরাধ মানুষের শাস্তি না হয়। আজ এ বিতর্ক নিয়ে কিছু আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। প্রথম পক্ষের যুক্তি হচ্ছে শান্তির কঠোরতার কারনে অপরাধ প্রবনতা কমে আসে। জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধ খুন, পাচার, এসিড সন্ত্রাস, যৌতুকের জন্যে হত্যা, শিশু ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ নির্মূলে ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ড সাজা বহাল রাখতে হবে। খুনের বদলা খুন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকেও ক্রসফায়ারের নামে আইনের লেবাস পরিয়ে দায়মুক্তি দেয়ার অপচেষ্টাও সভ্যসমাজ দেখছে। আবার নিরপরাধ মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা মিথ্যা সাজানো মামলা দিয়ে শক্তিধরদের বিচারের নামে প্রহসনের কথা ইতিহাসের পাতায় লিখা আছে। সক্রেটিস এর মতো দার্শনিককে এভাবে জীবন দিতে হয়। উপমহাদেশের এমন একটি বিচারের নামে প্রহসনের নাটকের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ডের ঘটনা নন্দলালের ফাঁসি। বিচারপতি ইম্পে ছিলেন বৃটিশ গভর্নর এর ব্যাক্তিগত বন্ধু। দিনরাত বিশেষ আদালত বসিয়ে ফাঁসির আদেশ হাসিল ও কার্যকর করা হয়। একারনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে কখনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় না বরং অপরাধীকে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত করানোই সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত মনে করে অনেকেই। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ টি মানবাধিকার সংস্থা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমেই যে সংস্থাটির নাম আসে সেটি হল এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যপী মৃত্যুদন্ড রহিত করতে সব সময় সোচ্চার। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মৃত্যুদন্ড রিপোর্ট (Death Penalty Report 2008) প্রকাশ করে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৮ সালে বিশ্বের ২৫ টি দেশের কমপক্ষে ২,৩৯০ জন লোকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এবং রায় প্রদান করা হয় ৫২ টি দেশের ৮,৮৬৪ জনের বিরুদ্ধে। শাস্তির ৪ টি মতবাদ (theory) আছে- ১. অন্যকে ভয় পাইয়ে দেওয়া যে অপরাধ করলে কি পরিনাম হতে পারে (Deterrent Theory), ২. অপরাধীকে আটকে রেখে নতুন করে অপরাধ ঠেকানো (Preventive/ Incapacitation Theory), ৩. যতটুকু অপরাধ, বিনিময়ে ততটুকো ফেরৎ দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া (Retributive Theory), ৪. ভাল হওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়া (Reformative Theory)। মৃত্যুদন্ড (Death Penalty) প্রতিশোধমূলক (Retributive) শাস্তি ব্যবস্থার একটি উদাহরণ। মৃত্যুদন্ড নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতানৈক্য আছে। Amnesty International এর রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীতে ১৪২ টি দেশে মৃত্যুদন্ড নেই, অপরাধ যত বড়ই হোক, তারা কাউকে মৃত্যুদন্ড দিবে না। ৫৬ টা দেশ তাদের আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে দিয়েছে। এই ৫৬ টির মধ্যে ২৩ টি দেশ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে এবং এগুলোর মধ্যে ১ নম্বর চায়না, ২ নম্বর ইরান, ৩ নম্বর সৌদি আরব। বাংলাদেশ মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা ৫৬ টা দেশের মধ্যে একটি হলেও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার হার খুব বেশি নয়। আমাদের দেশে মোট ১৭ টি আইনে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে এবং সবমিলিয়ে ৬০ টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য। ৯২ টি দেশে মৃত্যুদন্ড আইনত নিষিদ্ধ। আর ৪৬ টি দেশে মৃত্যুদন্ডের কার্যত কোন প্রয়োগ নেই। অর্থাৎ, সবমিলিয়ে ১৩৮ টি দেশ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করে পর্তুগাল, ১৯৭৬ সালে। আর এই তালিকায় সর্বশেষ যোগ হয় ২০০৮ সালে উজবেকিস্তান ও আর্জেন্টিনা। ২০০৮ সালে বিশ্বে সর্বাধিক মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় চীনে, কমপক্ষে ১৭১৮ জনকে। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গত বছর ইরান ও সৌদি আরব যথাক্রমে ৩৪৬ ও ১০২ মৃত্যুদন্ড দেয়। রায় প্রদানের দিক থেকেও সর্বধিক চীন। ২০০৮ সালে ৭০০৩ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করে চীনে। তার পরের অবস্থান ইরাক ও পাকিস্তানের , যথাক্রমে ২৮৫ ও ২৩৬ বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করা হয়। গতবছর বাংলাদেশের ১৮৫ বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করা হয়। অঞ্চল ভিত্তিতে সবথেকে বেশি মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এশিয়ায়, প্রায় ৭৬%। আর সবথেকে কম মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ইউরোপ ও সাব-সাহারান আফ্রিকায়, ইউরোপে শুধুমাত্র ১টি দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান চালু আছে, সেটি বেলারুশ। অঞ্চল ভিত্তিতে ২য় সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ড মধ্য প্রাচ্যে, প্রায় ২১%। এর মধ্যে ইরানে ৩৪৬ ও সৌদি আরবে ১০২ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় । যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর ৩৭ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে গত বছর মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করা হয়। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট ১৫টি অঙ্গরাজ্যে মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করা হল। রাষ্ট্র কর্তৃক জীবন সংহার হচ্ছে সরকার গ্রহণ করতে পারে এমন কঠোরতম ব্যবস্থাগুলোর একটি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বাস করে যে মৃত্যুদন্ড জীবনের অধিকারকে লঙ্ঘন করে, অপরাধ কমানোতে এর কোনো সুস্পষ্ট প্রভাব নেই এবং আধুনিক অপরাধ বিচার পদ্ধতিতে এর কোনো স্থান নেই। এখন বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দেশ আইন করে বা প্রায়োগিকভাবে মৃত্যুদন্ড বিলোপ করেছে। মৃত্যুদন্ড প্রদানকারী দেশগুলো থেকে মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ দেশগুলোর অপরাধ প্রবনতার পরিসংখ্যান থেকেই এটা প্রমানিত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শক্ত। গত বছর বাংলাদেশে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ৫ জনকে। এবং মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান হয় ১৮৫ জনকে।নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪টি ধারার মধ্যে ১২টিতেই বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান ছিল। মৃত্যুদন্ডের বিধান-সংবলিত ধারাগুলো ছিল ৪, ৫(১) (২) (৩), ৬(১) (২), ৮, ৯(২) ও (৩), ১১ (ক), ১২ এবং ৩০। পরে ৫ ও ৬ ধারার অপরাধ অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ এবং মানব পাচারসংক্রান্ত দুটি আইনের অংশ হয়ে যাওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইন থেকে এসব ধারা বিলুপ্ত হয়। যে কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মৃত্যুদন্ডের ধারার সংখ্যা ৭টি। এখন আবার আইন সংশোধন করে ধারা ৯(১)-এ যাবজ্জীবন শাস্তির পরিবর্তে করা হচ্ছে ‘যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ড’। এই সংশোধনীর ফলে আইনে মোট ৮টি ধারায় মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে। প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিশেষত হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে। ১৮০০ সালের মধ্যে ব্রিটেনে ২০০ টা অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল। ইসলামিক শরিয়া আইন অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড একটি প্রচলিত শাস্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন মানবতাবাদী লেখক, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারকগণ মৃত্যুদন্ডের বিরোধীতা করতে শুরু করেন। এটা মানবতাবিরোধী, অমানবিক ও অধঃপতিত একটা শাস্তি। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনাপত্র জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হবার পর ৪টা দেশ অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের আইন বাতিল করে।১৯৭৭ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ তে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ১৪০ টা দেশ মৃত্যুদন্ডের আইন বাতিল করে। মৃত্যুদন্ডের শাস্তি মানেই রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার হরন করা। এ দন্ড সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনাপত্রের দু’টি বিধানকে লঙ্ঘন করে। প্রথমটা হল – জীবন ধারনের অধিকার। দ্বিতীয়টা হল- অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫০ জন বন্দীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় যারা পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। অনেক মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রধান ভূমিকা পালন করে যা অত্যাচার করার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। সমাজের দরিদ্র শ্রেণী, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশী মৃত্যুদন্ডের শিকার হয় বিচার নিরপেক্ষতার অভাবে। দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন রাখা মানবিক আদর্শের পরিপন্থী।মৃত্যুদন্ডের পক্ষে যুক্তি: প্রত্যেক মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। যারা সজ্ঞানে একজন মানুষের বাঁচার অধিকার হরণ করে তারা নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকারও হারায়। মৃত্যুই তার যথার্থ প্রাপ্য। মৃত্যুদন্ডের ফলে শুধু হত্যাই নয়, অন্য যেসব অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডের বিধান আছে সেই অপরাধগুলো সহজে করবে না অপরাধীরা। মৃত্যুদন্ড খুন করতে ইচ্ছুক মানুষদের একটা ভীতির মধ্যে রাখতে সমর্থ্য হয়। মৃত্যুদন্ড আইন বাতিল হলে অপরাধপ্রবণ লোকদের সাহস বেড়ে যাবে এবং তারা বড় ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশের অতীতে বহু আলোচিত খুনী এরশাদ শিকদারের কথা কি আপনার মনে আছে? সে ৬০ টি খুন করেছিল। ১ম ব্যক্তির হত্যাকান্ডের পর যদি তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হত তবে কি বাকি ৫৯ জন মানুষের জীবন রক্ষা পেত না? মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে যুক্তি: অবশ্যই প্রতিটা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং কারোর বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করাটা দন্ডনীয় অপরাধ। এতে কোন সন্দেহ নেই। দন্ড হিসেবে আপনি ৩০ বছর জেল দেয়া যায়। ৩০ বছর বন্দী থাকা মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয়ানক। এক বছর বন্দী থাকলেই মানুষ পাগল হয়ে যায়। কেউ বন্দী জীবন চায় না, খাচায় বন্দী পাখির জীবন কারোর কাম্য নয়। সবাই আকাশে উড়া পাখির মত মুক্তভাবে সমাজে চলে ফিরে বেড়াতে যায়। বন্দীত্ব কি কম শাস্তি মনে হয় নাকি? এটা বিশাল ব্যাপার। ঠান্ডা মাথায় খুনীদের ৩০ বছর ও রাগের মাথায় যারা খুন করে তাদের ২০ বছর কারাদন্ডের আইন করুন। এটাই যথেষ্ট। অপরাধ বিজ্ঞানী সিজার বেকারিয়ার মতে, হত্যা একটা অপরাধ। সমাজ হত্যাকে ঘৃণা করে। কিন্তু হত্যার শাস্তি হিসেব সেই হত্যাই যখন রাষ্ট্র ঠান্ডা মাথায় কোন হত্যাকারীর উপর আরোপ করে তখন সেই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা যায় না। জীবন কেড়ে নেবার অধিকার হত্যাকারীরও নেই, হত্যার বিচারকার্য পরিচালনা করা রাষ্ট্রেরও নেই। হত্যা হল সবচেয়ে বড় অপরাধ। যেখানে হত্যা করলেও হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায় না। সেখানে অন্যান্য অপরাধের জন্য (ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি) মৃত্যুদন্ড দেয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। শুরুতেই বলেছি- ভয় দেখিয়ে কাউকে কোন কিছু করা থেকে বিরত রাখা যায় না। মৃত্যুদন্ড কখনোই খুন করতে ইচ্ছুক মানুষদের ভীতির মধ্যে রাখতে সমর্থ্য নয়। ঈংল্যান্ডে রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় পকেটমারের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। জনসমক্ষে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সময় সেই ভীড়ের মধ্যে পকেটমারেরা তাদের কাজ করত। পকেটমারদের ফাঁসী অন্য পকেটমারদের মনে কোন ভয়ের সঞ্চার করত না। যদি মৃত্যুদন্ড জিঘাংসাপ্রবণ মানুষদের মনে ভয়ের সঞ্চার করতে পারত তবে মৃত্যুদন্ড থাকা দেশগুলোয় অপরাধের হার কম হত। কিন্তুদেখা গেছে যেসব দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে সেসব দেশেই সবচেয়ে বেশী খুন হয়। আর যেসব দেশে মৃত্যুদন্ড নেই বা আইন খুব কঠোর নয়, ওসব দেশে খুন তো দূরের কথা যেকোন অপরাধ নেই বললেই চলে (ইউরোপের দেশগুলো)। মৃত্যুদন্ড উঠিয়ে দিলে অপরাধপ্রবন লোকদের অপরাধ করতে উৎসাহ বাড়বে-এ ধারণা একেবারেই ভুল। এর জ্বলন্ত উদাহরণ কানাডা। কানাডা ১৯৭৬ সালে মৃত্যুদন্ড তুলে নেয়। ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কানাডায় খুনের হার ৭০% কমে গিয়েছে। এরশাদ শিকদারের ১ম খুনের পর তাকে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে ২০ বছর কারাদন্ড দিয়ে রাখলেই হত। সে জেল থেকে বের হতেও পারত না, কাউকে মারতেও পারত না। খুনই হোক বা অন্য কোন অপরাধই হোক, অপরাধীকে বুঝাতে হবে যে-সে যেই কাজটা করেছে তা অন্যায়। অনেকে জেনেশুনেই অপরাধ করে। একটা কাজ খারাপ, অন্যায়, অপরাধ জেনেও সে এই কাজটা করে। এ ধরনের লোকদের বুঝিয়ে লাভ নাই যে কাজটা অপরাধ। তাছাড়া কিছু কাজ নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হলেও বিভিন্ন দেশের আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত থাকে (যেমন-ধর্ম সমালোচনা)। এসব ক্ষেত্রে আইন নিজেই অন্যায় আইন। মৃত্যুদন্ডযোগ্য কোন অপরাধ হলে তো আর সাথে সাথে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় না। এটা একটা দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া। প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট (চার্জসিট) দেয়। তারপর চার্জ/অভিযোগ গঠন হয় (কার বিরুদ্ধে কি অপরাধের অভিযোগ)। এরপর সাক্ষী শুরু হয়- রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ঘটনা বলে, আসামী পক্ষ জেরা করে। কোন আসামী পলাতক থাকলে বা আদালতে উপস্থিত না হলে পদ্ধতিগত ভাবে পলাতক ঘোষণা (Section 339B, CrPC) করতে হয়। অতঃপর খজ Manual এর বিধান মতে পলাতক এর জন্য রাষ্ট্র সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে যাকে State Defence বলা হয়। পলাতক আসামী বিচার পরবর্তী সময়ে আটক হলে সে আর কোন আইনী প্রতিকার লাভে হকদার হয় না, কেননা সে পলাতক হয়ে (fugitive) আইনী প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করেছে। উপরন্ত তার পক্ষে সরকারি খরচায় নিযুক্ত আইনজীবী আইনী লড়াই চালিয়েছে। রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষ্য শেষ হলে আসামীকে দোষীসাব্যস্ত করা যায়- সাক্ষ্যের এমন অংশ আবার পড়ে শুনিয়ে বলতে হয় (CrPC এর ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা), এ বিষয়ে আপনার কোন ব্যাখ্যা আছে কিনা, আপনি দোষী কি না এবং নিজের পক্ষে কোন সাক্ষী দিবেন কিনা। সাধারণত আসামীপক্ষ কোন সাক্ষী দেয় না, কেননা প্রমানের ভার সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপক্ষের। এরপর শুরু হয় যুক্তিতর্ক (Sec. 265J, CrPC)। রাষ্ট্রপক্ষ বলে, কেন শাস্তি হবে, আসামীপক্ষ বলে, কেন খালাস পাবে। তারপর আদালত সাক্ষ্য, প্রমাণ সব বিবেচনায় নিয়ে রায় দেয় (Sec. 265K, CrPC)। মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধে আসামীর দোষ প্রমাণ হলে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়- তবে কোনটা হবে তা নির্ভর করে, অপরাধের মাত্রা ও তা সংঘটনের প্রক্রিয়ার উপর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৬ টি অপরাধ আছে যার একমাত্র শাস্তিই হলো মৃত্যুদন্ড (Mandatory Death Sentence) [১. সংবিধান স্থগিত বা বিলোপ করা, ২. যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত আসামী কর্তৃক হত্যাকান্ড, ৩. যাবজ্জীবন দন্ডে দন্ডিত আসামী কর্তৃক হত্যাচেষ্টা, ৪. যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে হত্যা, ৫. বিমান বাহিনী আইনে বিদ্রোহ, ৬. নৌ বাহিনী আইনে বিদ্রোহ]। অপরাধের দন্ড মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন- যাই দিক- বিচারক কেন এমন শাস্তি দিলো রায়ে তার কারণ উল্লেখ থাকবে [Sec. 367(5), CrPC]। মৃত্যুদন্ডের আদেশে লেখতে হয়, ‘মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হোক’ (Sec. 368, CrPC)। জেলা পর্যায়ে সেসন কোর্টে মৃত্যুদন্ড হলেই সবশেষ- তা নয় ববং আইনী লড়াই এর শুরু বলা যায়। মৃত্যুদন্ড হলে আসামীপক্ষকে ৭ দিনের মধ্যে মাননীয় হাইকোর্টে আপীল করতে হয় (Sec. 371 CrPC)। রায় ঘোষণার ৩ দিনের মধ্যে (Rule 118 Cr.R.R.O) সমস্ত কাগজপত্র Confirmation এর জন্য (Sec. 374 CrPC) হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। আসামী আপীল না করলেও হাইকোর্ট স্বয়ং সবকিছু পর্যালোচনা করে রায় দিবে। হাইকোর্টও মৃত্যুদন্ড বহাল রাখলে মাননীয় আপীল বিভাগে আপীল হবে। আগে স্বয়ংক্রিয় ভাবে আপীল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে আপীল বিভাগের অনুমোদন ছাড়া কোন মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে না (Article 103, Constition)। একজন মানুষের জীবন যেন কোন ভুল বিচারের শিকার না হয়, এ জন্য এতগুলো স্তর রাখা হয়েছে। যা হোক, আপীল বিভাগও মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখলে রিভিউ করা যাবে। রিভিউ হলো একই বিষয়ে পুনরায় বিবেচনা করার আবেদন। ৯৯% ক্ষেত্রেই জবারবি মঞ্জুর হয় না। সর্বশেষ আইনী পদক্ষেপ হিসেবে আপীল বিভাগের আদেশ প্রাপ্তির পর ২১ দিন হতে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় Sec.991 VI, Jail Code)। আইনগত লড়াই এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দন্ডিত মহামান্য রাষ্টপতির নিকট ক্ষমা ভিক্ষা (clemency) করার সুযোগ পাবে [Art 49, Constitution & Sec. 991, Jail Code। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের দিনক্ষণ ঠিক করার পর আত্মীয়স্বজনকে শেষ দেখা করার জন্য খবর দেয়া হয় (Sec. 999 Jail Code)। মৃত্যুদন্ড রাতের যে কোন সময় কার্যকর করা হয় (Sec. 1001 Jail Code))। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, ডাক্তার উপস্থিত থাকেন (Sec.1003 Jail Code)। সবকিছু প্রস্তুতের পর ফাঁসির দড়ি দন্ডিতের গলায় লাগানোর পর জেল সুপারের ইশারায় সহকারী (hangman) লিভার টেনে ফাঁসি কার্যকর করে। ২৫.৪ ডায়ামিটারের ম্যানিলা দড়িতে ৩০ মিনিট ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার নিয়ম(sec.1006, Jail Code), তবে সাধারণত ৫/১০ মিনিট রাখাই মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য যথেষ্ট হয়। তারপর পোস্টমর্টেম করে লাশ নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন এর নিকট বুঝিয়ে দেয়া হয় (Sec.1007, Jail Code) মৃত্যুদন্ড কার্যকর পদ্ধতি একেক দেশ একেকভাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে থাকে। কিছু দেশে একাধিক পদ্ধতি বিদ্যমান। যেমন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২৯টি স্টেটস মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছে। তার মধ্যে কোনো কোনো স্টেট Electrocution এবং কোনো কোনো স্টেটস lethal Injection ব্যবহার করে। চীনে গুলি ও ইনজেকশন দুটোই চললেও সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, তাদের সর্বোচ্চ আদালত ‘lethal Injection’ কে বেশি মানবিক পন্থা মনে করছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র নসম্মুখে ফাঁসি কার্যকর করে- যেমন সৌদি আরব, ইরান। ক) কতল (Beheading): সৌদি আরব, খ) বৈদ্যুতিক চেয়ার (Electrocution): যুক্তরাষ্ট্র, গ) ফাঁস (Hanging) বাংলাদেশ, বোতসোয়ানা, মিশর, ইরান, ইরাক, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, সাউথ সুদান, সুদান, সিরিয়া, ঘ) বিষাক্ত ইনজেকশন (lethal Injection): চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, ৬) গুলি (Shooting): বাহরাইন, বেলারুস, চীন, উত্তর কোরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন। মৃত্যুদন্ড আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩২ (right to liberty and life) এর পরিপন্থী। মৃত্যুদন্ডের ফলে একজন সন্তান তার পিতা-মাতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। অপরদিকে ভিক্টমেরও জীবন ধারণের অধিকার ও তাঁর পরিবারের দুঃখ যন্ত্রনায় বিষয়টিও প্রণিধানযগ্য।এখানে ক্রিমিনাল বিহেভিয়ার সংশোধনের সুযোগ নেই habitual murderer, cold blooded murder দের ক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ কম। এজন্য তাদের জন্য মৃত্যুদন্ড রাখা উচিত। যাতে সমাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা যায়। তবে কেউ যদি পরিস্থিতির শিকার হয়ে খুন করে, যেমন জমি জমা বিরোধ, তখন মৃত্যুদন্ড দেয়া অমানবিক। মৃত্যুদন্ড দেয়ার ক্ষেত্রে অপরাধী কোন সামাজিক অবস্থায়, কোন প্রেক্ষাপটে, কোন অপরাধ করেছে,সংগঠন তা ব্যক্তিত্ব বিবেচনায় রেখে এই শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে।কখনও কখনও মৃত্যুদন্ড বিপরীত প্রভাব ফেলে। যারা জানে যে তাদের মৃত্যুদন্ডের ঝুঁকি রয়েছে তারা তখন তাদের অপরাধের সাক্ষীদের হত্যা করে করা যারা তাদের চিহ্নিত করতে এবং দোষী সাব্যস্ত করতে সক্ষম হতে পারে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হলে যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উপরের বিষয়গুলোর সার্বিক বিবেচনায় সর্বক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের বিধান না রেখে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যেমন অভ্যাসগত খুনিদের ক্ষেত্রে তা বহাল রাখা উচিত।

লেখক : আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী