মৃত্যুঞ্জয়ী ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান

34

অধ্যাপক মেজর (অব.) নূরুল হুদা কুতুবী

ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান মানে প্রাচ্যের এক খ্যাতিমান, ইতিহাসবিদ। ড. মইনুদ্দীন আহমদ খানের অর্থ প্রথিতযথা শিক্ষাবিদ। ইসলামি গবেষণা আন্দোলনের অগ্রনায়ক হিসেবে যাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে তিনিই হলেন সেই ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান। ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর ৪২তম অধস্তন পুরুষ বিধায় তাঁর জন্ম ও জন্মস্থান অত্যন্ত উঁচু বংশের ও অভিজাত পরিবারের মধ্যে। তিনি ছিলেন শান্তপ্রিয়, সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। আন্তর্জাতিক মানের স্কলার হয়েও তাঁর ব্যবহার ছিল মার্জিত। আচরণ ছিল পরিশীলিত। গৌরব ও অহংকার থেকে তিনি অনেক দূরে থাকতেন। তাঁর চলাফেরা ছিল একেবারে সাদাসিধে। জামাতের সাথে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষে নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াতসহ জিকির আসকার আদায় করতেন। প্রতি বছর রমজানে ইতিকাফে বসতেন। এরকম বিদগ্ধ জ্ঞানী ও অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার ‘চুনতি’ নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করে নিজস্ব মেধা ও জ্ঞানের সাহায্যে প্রাথমিক থেকে ¯œাতকোত্তর পর্যন্ত প্রথম বিভাগ ও স্বর্ণপদক লাভ করে বহু কৃতিত্ব অর্জন করেন। এছাড়া নিজস্ব উজুল মেধার আলোতে তিনি উদ্ভাসিত হয়েছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন পরিশ্রমী, বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান ঐতিহাসিক হিসেবে।
আবার এ মনীষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। পরবর্তীতে উপমহাদেশের খ্যাতনামা প্রতœতাত্তি¡ক গবেষক ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত¡াবধানে ‘ফলায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে ডক্টোরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলি শাখায় ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে রাজনীতি রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তুলনামূলক ধর্মতত্তে¡র প্রখ্যাত গবেষক, পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদ ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের (১৯১৬-২০০০) সান্নিধ্যে আসেন এবং তার তত্ত¡াবধানে গবেষণা করতে গিয়ে ড. খানের চিন্তার রাজ্য প্রসারিত ও বিস্তার লাভ করতে থাকে। ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাস ও তাঁর অধীত বিষয় হলেও দর্শন, পদার্থ, রসায়ন ও এক্সপেরিমেন্টাল মায়েন্সের প্রতি তাঁর খোঁক প্রবণতা ছিল বেশি।
তিনি লেখাপড়া, গবেষণা ও অন্যান্য ডিগ্রি গ্রহণ করার পর ১৯৬১ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। আবার সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক ডিগ্রি লাভ করে ইসলামাবাদে ইসলামিক রিচার্চ ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজ দেশে চলে এসে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে ইতিহাস বিভাগ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগকে পৃথক করে একটি নুতন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে ঐ বিভাগের প্রতিষ্ঠিাতা চেয়ারম্যান হিসেবে অদ্যাবধি সুপরিচিতি লাভ ও সুনাম অর্জন করেন। এদিকে ১৯৭৪ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কার্যক্রম চালু হয় আবার অন্যদিকে তিনি একই বছরে প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৪ সালে আমি প্রবন্ধকার নূরুল হুদা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে এসে ব্যর্থ হয়ে ঐ ভবনের ৪র্থ তলায় ওঠলে ড. মইনুদ্দীন আহমদ খানের সাথে আমার দেখা হলে আমি তখন তাঁকে সালাম জানাই। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ভর্তি হওয়ার জন্য আসলাম না অন্যকাজে। আমি ভর্তি হতে আসার কথা জ্ঞাত করলে তিনি আমাকে তাঁর চেম্বারে নিয়ে যান। সেখানে অনেক কথাবার্তার পর ড. খান আমাকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হতে বললে আমি তাঁর কথামত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভর্তি হই। এ বিভাগে ভর্তি হয়ে তাঁর সাহায্য ও সহযোগিতায় আমি মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণ করি। ড. খানের এ সহযোগিতা আমি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব। ড. খানের পাÐিত্য, বাচনভঙ্গি, কথোপকথনের ধরন-কৌশল, শ্রেণিকক্ষে নিজস্ব বক্তব্যের সম্মোহনী উপস্থাপনা তিনি যেকোন ছাত্রকেই মোহিত করে ফেলতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর বক্তৃতা শুনে কখনো কাকেও বিরক্ত হতে দেখেনি, বরং তাঁর বক্তৃতা বন্ধ হলে মনে হতো আরো অনেকক্ষণ বললে আরো বেশি বেশি তথ্য জানা যেত।
একজন মহৎ শিক্ষক ও গবেষকের যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার প্রফেসর ড. মইনুদ্দীন আহমদ খানের মধ্যে তার সবগুলোই পূর্ণমাত্রায় ছিল। মহাকবি ইকবাল যেমন বলেছেন, ‘শিক্ষক মোরা শিক্ষক, ধরণীর মোরা পরমাত্মীয়, মানুষরা দীক্ষক।’ তেমন প্রতিচ্ছবিই পাওয়া যয় তাঁর মধ্যে। মানুষকে দীক্ষা দেওয়ার, শিক্ষা দেওয়ার, প্রশিক্ষিত করার তীব্র স্পৃহা তাঁর মধ্যে ছিল। ক্লাশে বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে যে রসবোধ তিনি সৃষ্টি করতেন নিতান্ত খ্যাতিমান শিক্ষক ছাড়া তা সকলের পক্ষে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।
ছাত্রদের প্রতি ড. খানের আচার-আচরণ ছিল পিতৃসুলভ। তাঁকে ছাত্ররা এত ভয় করতো যাতে চলার পথে তাঁর সাক্ষাৎ না মেলে। সৎচরিত্রবান ছাত্রদের তিনি বেশি পছন্দ করতেন। যদি পথে দেখা হয় তাহলে লেখাপড়া ও গবেষণার কথা জিজ্ঞাসা করতেন। একাডেমিক কোন বিষয়ে তাঁর নিকট পরামর্শের জন্য গেলে তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে তা বুঝিয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর দূরদৃষ্টি মরীচিকার মত হারিয়ে যেতনা বরং স্থান পেত বাস্তবতার অসীম বাতাবরণে। তাঁর কাছে কোনদিন কোনরকম পরক্লিষ্টভাব দেখা যায়নি।
ড. খান চিন্তার স্বাধীনতা ও পরিধি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন।এক্ষেত্রে ইমাম হাসান আল বসরির চিন্তাদর্শনে তিনি বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয়। ‘ফ্রিডম অব চয়েস এন্ড ডিটারমিনিজম’ নামক একটি জটিল বিষয়কে তিনি খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দিতেন। মাস্টার ডিগ্রিতে ইসলামিক চিন্তাবিদদের কোন বই না থাকায় তাঁর রচিত ইবনে ফারাবি, ইবনে খালদুন ও ইবনে তাইমিয়ার বই ছাত্রদের পড়ার জন্য প্রদান করা হতো। ইসলামিক চিন্তবিদদের ওপর কোন গবেষণা মূলক বই না থাকায় দর্শন বিভাগে ও ড. খান ক্লাস নিতেন। এখানে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা বিভাগের ডীন প্রফেসর সাব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. খানের মতে, ফ্রিডম অব চয়েজ এর অর্থ হলো কর্মের স্বাধীনতা। অর্থাৎ আপনি যেটা করতে চান, সেটা স্বাধীনভাবে করার স্বাধীনতা থাকা আর ডিটারমিনিজম হলো স্বাধীনতার উল্টো, মানে বাধ্যবাধকতা। একথাটা এসেছে তকদিরের বিশ্বাস থেকে। তকদির মানে হলো আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্ট জীবের ইচ্ছা এবং কর্মধারা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহর নির্ধারণীকে তকদির বলা হয়। আপনি তকদিরের বাইরে কোনো কিছু করতে পারবেননা। আল্লাহ আপনার জন্য যেটা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এর মধ্যে আপনাকে থাকতে হবে। যেমন ধরুনÑ আল্লাহ গরু সৃষ্টি করেছেন এরপর গরুর জীবন রক্ষা করতে এবং প্রতিপালনে তার রিজিক ও পাওনা বরাদ্দ করে দিয়েছেন। এটাকে বলে ডিটারমিনিজম। আল্লাহ তায়ালা গরুর রিজিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন ঘাসপাতার মধ্যে। গরু হাজার চেষ্টা করলেও নিজের শরীরকে মোটা-তাজা করার জন্য মাংস খেতে পারবেনা। গোস্ত তার রিজিকের মধ্যে নেই।
শিক্ষকতা ও গবেষণা তার জীবনের মহৎ পেশা। তারপরও সরকার তাঁরমত একজন মহান ইসলামিক চিন্তাবিদকে পেয়ে ১৯৭৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। এতে তিনি বেশিদিন চাকুরী করেন নাই। তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। আবার ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফের পীর মাওলানা শাহ আব্দুল জাব্বার (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাঁর সূদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক পথ উৎরিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চপদ উপাচার্য পদে নিয়োগ পান।
উল্লেখ্য ২০০২ সালে চট্টগ্রামের অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত ভি সি, হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সিন্ডিকেট মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ড. মইনুদ্দীন আহমদ খানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ১৮টি মৌলিক গ্রন্থ। তাছাড়া দেশি বিদেশি গবেষণা জার্নালে তাঁর বহু নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত¡, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক ইতিহাস, মুসলিম সামাজিক ব্যবস্থাপনা, বিশ্বব্যাপী সংস্কার আন্দোলন, ফারাবির চিন্তাদর্শন, ইবনে খালদুনের সমাজদর্শন, শহীদ তিতুমীরের আন্দোলনের স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ে ১০০টি মৌলিক নিবন্ধ রচনা করেন। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক সেমিনার ও ধর্মীয় সম্মেলনে যোগদানের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
“এনেছিল সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাও তুমি করে গেলে দান”।
লেখক: গবেষক ও প্রবন্ধকার