মূল্য তালিকা ক্রেতার জন্য নয়, ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য!

275

রমজানে নগরীর বাজারগুলোতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। প্রতিদিন কোনো না কোনো বাজারে অভিযান পরিচালনা করছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বাজার তদারকি দল। প্রতিটি অভিযানে মিলছে অনিয়মের-অপরাধের প্রমাণ। অপরাধের দায়ে বিক্রেতাদের করা হচ্ছে জরিমানা। কিন্তু অভিযান-জরিমানায় কি বাজারে কোনো পরিবর্তন ঘটে? বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণে গতকাল নগরীর ৫টি কাঁচাবাজারে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলা হয়।
সরেজমিনে জানা গেল, বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট গেলেই ব্যবসায়ীরা মূল্য তালিকা টাঙান। ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাওয়ার সাথে সাথে পণ্যের মূণ্য আবারও বাড়িয়ে দেন। ক্রেতাদের কেউ মূল্য তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ব্যবসায়ীরা কোনো রাখঢাক না রেখেই বলছেন, মূল্য তালিকা কেবলই ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা থেকে রক্ষার জন্য তার আসলে টাঙানো হয়, ক্রেতার জন্য তা নয়। ক্রেতারা বলছেন, ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাওয়ার কোনো ব্যবসায়ীকে করা জরিমানার টাকা পুষিয়ে নিতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বা ওজনে কম দিতে মরিয়া হন বিক্রেতারা।
বিক্রেতাদের দাবি, প্রশাসন যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে খুচরা বিক্রেতারা পণ্য বিক্রি করে লাভ করতে পারে না। এমন ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত নয় ক্রেতা-বিক্রেতারা উভয়ই। জরিমানা করলে কিছু করার নেই। ব্যবসা করেই তো সংসার-জীবন চালাতে হবে। তাই নিরুপায় হয়ে এমনটা করছেন।
ক্রেতাদের উপর দোষ চাপিয়ে অনেক বিক্রেতা বলেন, মূল্য তালিকায় যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, সে দামে ক্রেতারা কিনে না। তারা ৫ টাকা হলেও কম দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ জন্য তারা তর্কও করেন।
গতকাল সন্ধ্যায় নগরীর কাজীর দেউড়ি কাঁচা বাজারে সরেজমিন দেখা যায়, দুইটি ছাগলের মাংস ও একটি মুরগির দোকান ছাড়া কোনো দোকানে মূল্য তালিকা নেই। তারা জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানছেন না। সবাই পুরনো পদ্ধতিতে দর কষাকষির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছেন।
মাংস বিক্রেতারা জানালেন, গরুর মাংসের দাম ৬৮০ টাকা। কিন্তু ইফতারের পর বিক্রির শেষ সময়, তাই সে দাম ৬৫০ টাকা হয়েছে। পুরো বাজারে দুইটি ছাগলের মাংসের দোকানে টাঙানো হয়েছে মূল্য তালিকা। যেখানে লেখা ‘ছাগলের মাংসের দাম ৭৫০ টাকা’। তারপাশে একটি মুরগির দোকানে টাঙানো হয়েছে তালিকা। যেখানে দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা, ফার্ম মুরগী ১৫০ টাকা, সোনালী মোরগ ২৭৫ টাকা লেখা আছে। তবে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেল ভিন্ন কথা। মূল্য তালিকায় তারা পণ্য বিক্রি করেন না। তারা ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা থেকে বাঁচতে কয়েকটি দোকানে লাগিয়েছেন মূল্য তালিকা।
শুধু কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজার নয়, নগরীর চকবাজার কাঁচাবাজার, বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার, অক্সিজেন মোড়ের কাঁচাবাজার ও ২নং গেটের কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গতকাল সকাল ১০টায় চকবাজার কাঁচাবাজারে অভিযান চালিয়ে ২৯ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। দোকানে মূল্যতালিকা না থাকা, ওজনে কম দেওয়া, ফলের মধ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়ায় এ জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্টেট রেজওয়ানা আফরিন। এখানে যতক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, ততক্ষণ বাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিকালে এ বাজারে দেখা যায়, বিক্রেতারা নিয়ম অমান্য করে পণ্য বিক্রি করছেন।
কয়েকজন বিক্রেতা জানান, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে কোনোভাবে পণ্য বিক্রি করে লাভ করা সম্ভব নয়। এছাড়া আমাদেরকে দিতে হয় ৩-৪ স্তরের চাঁদার টাকা। ক্রয়মূল্যের সাথে সরকার দলীয় লোকের চাঁদার টাকার হিসেব করলে, আমরা কয় টাকা লাভ করতে পারি- সেটা সরকারের জানা উচিত।
গত ২৯ এপ্রিল নগরীর বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার ও ২নং গেট কর্ণফুলী কাঁচাবাজারে অভিযান পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফোরকান এলাহী অনুপম। ওইদিন দুই বাজারে বিভিন্ন অপরাধে মোট ৪৩ হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি। শুধু জরিমানা নয়, সাথে সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন। এমনকি ম্যাজিস্ট্রেট বিক্রেতাদের ঈমান ঠিক রাখতে বলেছিলেন। গতকাল এসব বাজারে সরেজমিন গিয়ে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। যাচ্ছেতাইভাবে চলছে পণ্য বিক্রি। ক্রেতারা অসহায় হয়ে কিনছেনও। বিক্রেতারা অভিযান মোবাবেলায় মূল্যতালিকা মজুদ রাখেন।
ক্রেতারা বলেন, আমরা প্রতিদিনই দেখছি কোনো না কোনো বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালাচ্ছেন, আর জরিমানা করছেন। কিন্তু বাজারে এসে এর সুফল পাওয় যায় না। বিক্রেতাদের ইচ্ছেমত পণ্য বিক্রির স্থায়ী সমাধান দরকার।
এসব বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ কামাল হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, প্রতিদিনই যেখানে অভিযোগ পাচ্ছি, সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন ম্যাজিস্ট্রেটগণ। এর আগে বিক্রেতা ও বাজার পরিচালনা কমিটির সাথে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। তাদের কথা দেওয়া ও কাজের মধ্যে কোন মিল নেই। ম্যাজিস্ট্রেট যতক্ষণ অভিযান পরিচালনা করছেন, ততক্ষণ ঠিক থাকে। এরপর আবার একই অবস্থা। যার কারণে আমরা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কে ‘মোটিভেট’ করে যাচ্ছি। ক্রেতাদের একসাথে পণ্য কেনার মনমানসিকতা বদলাতে হবে। অন্যথায় এমন অবস্থা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে যাবে। তিনি সকল জনসাধারণকে নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে সচেতন হওয়ার আহŸান জানান।