মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে নাকি চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপরই

17

ঢাকা প্রতিনিধি

বিদ্যুতের দাম বাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ানো হলো বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) জ্বালানি বিভাগের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একলাফে ১৭৮ ভাগ এবং শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। যা কার্যকর হচ্ছে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। তবে আবাসিক ব্যবহারকারী, সার কারখানা ও পরিবহনে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করল সরকার। গত আট বছরের হিসাবে এবার গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ল।
দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে ভর্তুকির চাপ থেকে বেরিয়ে আসা এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যে যুক্তি সরকার দিচ্ছে, তার যথার্থতা স্বীকার করলেও এক ধাপে এতটা বৃদ্ধি মানতে পারছেন না গ্রাহকরা। শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও তার প্রভাবে পণ্যমূল্য বেড়ে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০০৯ সাল থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় গণশুনানির মাধ্যমে। এটি করে আসছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো যায় না। গত ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে সরকার। নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে চায় তারা। এরপর চলতি মাসেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এল নির্বাহী আদেশে।
গত বুধবার গ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারির পরে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যায় জ্বালানি বিভাগ বলেছে, খোলাবাজার থেকে চড়া দামে এলএনজি কিনে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বাড়তি চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য করণীয় নিয়ে অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়েছে।
আগে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে গ্যাসের দাম আলাদা ছিল। এবার সবার জন্য একই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুতের জন্যও একই করা হয়েছে গ্যাসের দাম। এতে এ চার শ্রেণির গ্রাহকের জন্য নতুন দাম করা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের। এরপর মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের। হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহকেরা ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের প্রতি ইউনিটে দাম দেবেন ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। আগে তারা দিতেন ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা।
এ নিয়ে গত ১৪ বছরে ছয় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশে এখন দিনে গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহের সক্ষমতা আছে ৩৭৬ কোটি ঘনফুট। আর এখন গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৬ কোটি ঘনফুট। দিনে ৩১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি নিশ্চিত করা যায়।
শিল্প মালিকদের মতে, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পের ওপর গ্যাসের দাম বাড়া বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যা এসব শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে, স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায় ব্যয় বাড়বে এবং এর চাপ যাবে ভোক্তার উপর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সব রকম পণ্যের দাম বাড়ে। এবার মানুষ ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। সরকারি হিসেবে সাড়ে আট ভাগ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবন যেখানে বেহাল, সেখানে এই মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা বলেন, এতে বাজারে পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়তে পারে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে এটিকে আরও উসকে দিতে পারে। গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপও আসলে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপরই। তাদের মতে গ্যাসের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানো উচিত হয়নি। এতে ভোক্তার ওপরই চাপ বাড়বে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। গত আগস্টে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির (সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ) পর বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন বিদ্যুতের পর গ্যাসের দাম বাড়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের খরচ বাড়বে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, গ্যাসের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে ভোক্তার ওপরই চাপ বাড়বে। ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিটের দাম একই অর্থাৎ ৩০ টাকা করাটাও যৌক্তিক হয়নি। তাতে ছোট-মাঝারি শিল্প সংকটে পড়বে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, জ্বালানির দাম যেভাবেই বাড়ানো হোক না কেন একসময় তা ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হয়। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, এতে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।