মুহূর্তেই কান্না থেমে গেল অবসরে যাওয়া শিক্ষক পত্নীর

33

জহুরুল ইসলাম

দরোজা খুলে হুট করে রুমে ঢুকে গেলেন ক্রন্দনরত এক মহিলা। চেহারায় উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা ও ক্লান্তির ছাপ। ‘সাহেবের’ কাছে তিনি কি বলতে এসেছেন বুঝা যাচ্ছিল না কান্নার শব্দে। সাহেব শুনতে চাইলেন তার কথা। দারিদ্রক্লিষ্ট, অসহায় মহিলা এলোমেলো অগোছালো হাতের লেখা একটা আবেদন এগিয়ে দিলেন সাহেব দেখলেন এবং শুনলেন তার কথা। আমরা ৩ জন এ সময় একই রুমে বসা। সে দিন ছিল রোববার (১৯ জুন)। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম দিকে কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও ভদ্রমহিলার বর্ণনায় জানতে পারলাম তার স্কুল শিক্ষক স্বামী অবসরে যাওয়ার পর মারা গেছেন। দীর্ঘ সময় স্বামীর পাওনা পাননি। সাহেবের সাথে দেখা করার আগ পর্যন্ত পাওনার টাকার জন্য হেটেছেন অজানা নানা পথে। তিনি আর পারছেন না সংসার চালাতে, সন্তানদের নিয়ে জীবন ধারণ করতে। বলে উঠলেন ‘স্যার আমার জন্য কিছু করেন আমি আর পারছি না।’
যে সাহেবের রুমে আমরা বসেছিলাম তিনি ঢাকার বেনবেইস ভবনের বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজুর অফিস কক্ষ। ভদ্রমহিলার কথা শুনে, দেখে ওই শিক্ষকের স্ত্রীর আবেদন তাৎক্ষণিক মঞ্জুর করে দ্রæত পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি বললেন ‘ঠিক আছে আর কান্নাকাটির দরকার নেই।’ দিয়ে দিয়েছি, টাকা আপনার একাউন্টে পৌঁছে যাবে। অতঃপর মহিলার কান্না থামল। অন্তর থেকে দোয়া ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন মহিলা আসমান ছোঁয়া স্বস্তি ও বিশ্বাস নিয়ে।
আলাপচারিতায় জানলাম আবেদনকারির তুলনায় অর্থ অনেক অপ্রতুল ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কাছে। তাই পাওনা নিষ্পত্তির আবেদনগুলোর স্তূপ বড় হয়। এছাড়া আছে ‘নানা সমস্যা সীমাবদ্ধতা’। বর্ণিত ঘটনায় মনে হলো কঠিন সীমাবদ্ধতা ও পরিস্থিতির মধ্যেও সদস্য সচিব তাৎক্ষণিক মানবিক উদ্যোগ নিয়ে তাৎক্ষণিক দুরদর্শিতা ও দক্ষতার সাথে। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করে একজন মানুষ রোগে, অভাবে মরে যাচ্ছেন, মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, শেষ জীবনে হজ্বে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন না বিষয়গুলো সহনীয়। এক্ষেত্রে রয়েছে অগ্রাধিকার বিবেচনা। ফলে বিধি বিধানের কঠিন জায়গায় বসে থাকা যায়না। সদস্য সচিব সম্ভবত তাই উল্লেখিত ঘটনার বেলায় খুব দ্রæত মানবিকতার জায়গায় চলে এলেন। প্রশাসক হিসেবে এটাই তার বিচক্ষণতা ও মানবিকতা। আরো লক্ষ্য করলাম ‘একসেসিবিলিটি’ – অর্থাৎ তার সাথে সহজে দেখা করা ও কথা বলতে পারার সুযোগ।
শাহজাহান আলম সাজু ভীষণ আলাপপ্রবণ, সজ্জন, রাজনীতি সচেতন ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। এ নিয়ে পর পর ৪ বার কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। জনপ্রিয় শিক্ষক নেতা এবং অধ্যক্ষও। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের শীর্ষ মহলে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তিনি শিক্ষকদের কিছু মৌলিক পাওনার ব্যাপারে নীরবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং রেখে চলেছেন। অবহেলিত বেসরকারি শিক্ষকগণ এখন ব্যাংক একাউন্টে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, বৈশাখি ভাতাসহ অন্যান্য কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন। এগুলো সাম্প্রতিক অর্জন। জাতীয় বেতন স্কেলে শতভাগ বেতনপান। কিছু বৈষম্য অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। একসময় বিদায় কালে কাঁধে গামছা, হাতে জায়নামাজ ও ভার দিয়ে হাঁটার জন্য লাঠি এবং বিমূর্ত ভালবাসা আর সম্মান নিয়ে বাসার দিকে যেতে অভ্যস্ত বেসরকারি শিক্ষকরা এখন জাতীয় বেতন স্কেলে যে যার অবস্থান অনুযায়ী একাকলীন অবসর ভাতা পান কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায়। ফান্ড অপ্রতুলতা ও দীর্ঘসূত্রিতাজনিত হতাশা দুর্ভোগ রাখবে এক্ষেত্রে সরকারি অবদান ও যৌক্তিক বিবেচনা দরকার। সেই সাথে দরকার শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের দক্ষ ও মানবিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামগ্রিক প্রয়াস। এতে এ সমস্যাও ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করেন সংশ্লিষ্টরা। সদস্য সচিব হৃদয় নাড়া দেয়া ক্রন্দনরত এ ভদ্রমহিলার টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলেছিলেন ‘যান আপনার কাজ হয়ে গেছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করবেন’। ওই নারী নিশ্চয় মন থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করবেন, সাথে তার দেখা ‘সাহেবের’ জন্যও দোয়া করবেন। অগ্রাধিকার বিবেচ্য এসব প্রকৃত আবেদনগুলোতে মানবিক সাড়া দেয়ার সৎ সাহস ও সামর্থ্য তৈরী করা মানুষগুলো প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে থাকুক-এটাই কাম্য। দুর্নীতি, ভোগান্তির বিপরীতে অসহায়ের কান্না থামিয়ে দেয়া উদ্যোগ আরো বাড়–ক সবখানে। বিশেষ করে শিক্ষার উন্নতি হোক, শিক্ষকের কল্যাণ উদ্যোগ আরো বাড়–ক। কথাচ্ছলে শাহজাহান আলম সাজু (সাজু ভাই হিসেবেই খ্যাত) বলছিলেন তার আরেকটি ভাল লাগার কথা। কিছুদিন আগে হঠাৎ তাঁর অফিসে এসে হাজির স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ও খ্যাতিমান লোক সংগীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। তিনি এসে বললেন তাঁর স্ত্রী দীপ্তি রাজবংশী (যিনি নিজেও লোকসংগীত ও শিক্ষক) জটিল হৃদরোগে ভুগছেন। চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নেই তাঁর। তিনদিনের মধ্যে পাওনা টাকার চেক রেডি করে তিনি ওই চেক নিয়ে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর বাসায় পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। হতবাক হলেন রাজবংশী দম্পতি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দ সৈনিক তার মহানুভতার এমন স্পর্শে সুখ লাভ করেছেন নিশ্চয় সেদিন। সরকার, রাষ্ট্র, প্রশাসন দুঃসময়ে মানবিক প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন এমন সংস্কৃতি আরো বেশী বিস্তৃত হোক। জনসম্পৃক্ত প্রশাসকগণ মানুষকে বুঝবেন, কান্না থামাবেন-এটি অনেক বড় কথা, সেবা প্রত্যাশীদের জন্য। আমরা কেন সেদিন বেনবেইস ভবনে গেলাম সে কথা আরেকদিন বলব।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক