মুজিববর্ষ অপারেশন সার্চলাইট; বাংলার নৃশংস ও বর্বরোচিত অধ্যায়

89

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন

পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংস, বর্বরোচিত ও নিষ্ঠুরতম গণহত্যার নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র, নিরীহ ও ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পূর্ব-পাকিস্তানের সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই হত্যাযজ্ঞ চানালো হয়। ‘সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে লাল রঙে রাঙাতে হবে’ রাও ফরমান আলীর এই আদেশই হয়তো বাংলা ভাষাভাষীকে সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধের বলিতে পরিণত করেছিল। মানুষ হয়ে মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা এবং ধর্ষণ এর মত পাষবিকতায় মেতে উঠেছিল পাকসেনারা। তুরস্কের অটোম্যান শাসনামলে আর্মি অফিসার এনভার পাশার নেতৃত্বে সংগঠিত বিংশ শতাব্দীর সর্ববৃহৎ ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’ অথবা কুখ্যাত হিটলারের ‘দ্য হলোকস্ট’ পৈশাচিকতাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া এই হত্যাযজ্ঞের বদলা হিসেবে পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যত গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে তাঁর কোনোটিই লিখিত সামরিক আদেশ জারি করে করা হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর। পাকিস্তান এই সেনা অভিযানের কোড নেম বা সাংকেতিক নাম দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। অপারেশনের প্রথম পর্ব চলে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব বলবৎ থাকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, “ওদের ৩০ লাখ মেরে ফেলো। বাদবাকিরা আমাদের হাত চেটে খেয়ে বেঁচে থাকবে (কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস)”। ১৯৭১ সালে পূর্ব-পাকিস্তানকে গণহত্যা ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে দমন করার জন্য ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক সামরিক অভিযান কার্যকর করার ক্ষেত্রে সর্বপরি ভ‚মিকা রাখে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। ১৮ই মার্চ সকালে, ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি এই অভিযানের পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেন। ইতিহাসের বর্বরতম এই পরিকল্পনাটি জেনারেল ফরমান নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের ৫ পাতা জুড়ে ১৬টি প্যারাগ্রাফে লিড পেন্সিল দিয়ে লিখে নেন। অপারেশন সার্চ লাইট শেষ হওয়ার পর, তিনি নির্বিচারে বাঙালি নিধনের সকল পরিকল্পনার অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। বিশেষ করে ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারীও ছিলেন এই ব্যক্তি।
হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনার শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েতা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রæয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে, পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান বাংলার সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন। এই কারণে অপারেশনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং লে জেনারেল টিক্কা খানকে প‚র্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়। মার্চেও ১৭ তারিখ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিও এস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব প্রদান করে।
জেনারেল ফরমান অপারেশনের সিদ্ধান্ত, এবং সাফল্যের শর্ত ইত্যাদির সীমা তৈরি করেন এবং জেনারেল খাদিম সেনাদলের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের উপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। এটা ধারণা করা হয় যে বাঙালি সেনারা অপারেশনের শুরুর সময় বিদ্রোহ করবে, তাই পরিকল্পনাকারীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপকালে বাঙালি সৈন্যদের অপারেশনের পূর্বেই নিরস্ত্র করার এবং বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন। ‘অপারেশনের সব কিছুই নির্ধারিত হল’ – হাতে লিখিত পরিকল্পনাটি ২০ মার্চে আবার জেনারেল হামিদ এবং লে জেনারেল টিক্কা পর্যালোচনা করেন। জেনারেল হামিদ তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নীরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলেও শুধুমাত্র ই পি আর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীদের নিরস্ত্র করার অনুমতি দেন। পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকার কমান্ডারদের কাছে বিতরন করে দেয়া হয়। অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সবকিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।
পরিকল্পনাকারীরা অপারেশনে নামার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট সব পাকিস্তানি ইউনিট কমান্ডার তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করে ফেলে। আর এই কাজটি তারা সম্পন্ন করে ফেলে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখেই। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা এবং আঞ্চলিক সেনানায়কদের কার্যবিবরণী প্রদান- এইসব কিছু সম্পন্ন করা হয় কোন ধরনের সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে। মার্চের ২৪ ও ২৫ তারিখে পাকিস্তানি জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন করেন এবং গ্যারিসন কমান্ডার ও অপারেশনের অন্যান্য সিনিয়র পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এই দলের সাথে ছিলেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিট্টা, কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল এবং প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ। জেনারেল ফরমানকে যশোরে পাঠানো হয়, জেনারেল খাদিম নিজে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করেন এবং ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রুস ও কর্নেল সাদউল্লাহ রংপুর সফরে যান। সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় ছিল। কেবল না জানলেই নয় এমন কিছু ক্ষেত্রে গুটিকয়েক লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। কিছু কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তানিদের ঘনঘন ব্রিফিং দেখে সন্দেহ করেছিলেন বটে। কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু কি ঘটেছে! সেটার সম্পর্কে আক্রমণের পূর্বে তারা বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারেনি।
এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাসনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা, চমকে দেয়া, প্রবঞ্চনা, এবং দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়। এজন্যে সেনাদেরকে নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্বও প্রদান করা হয়। যদিও পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হয়নি, এটা ধারণা করা হয় যে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার এবং বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীদের নীরস্ত্র করার পর সাধারণ জনগণদের ভয় দেখিয়ে এক সাপ্তাহের মধ্যে সামরিক শাষনের আওতাভূক্ত করা হবে। লে জেনারেল টিক্কা বলেন, ‘১০ এপ্রিলের পর আর কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না’। অপারেশন পরিচালনার জন্য ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট এইসব স্থান গুলো চিহ্নিত করা হয়। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। পরিকল্পনা করা হয়; পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্যদল এবং প্যরামিলিটারি বাহিনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দেবে। ঢাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ হলে পাকিস্তানের ৯ম এবং ১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে। প্রায় সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করার পরিকল্পনার সাথে সাথে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের ন্যাটা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী, সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহার, টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা, সকল বাঙালি সৈন্যদলের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আওয়ামী লীগের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন; এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন এইরকম পরিকল্পনা ছিল।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে যখন ২৭ মার্চ হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, তখনও জানা ছিল না কী ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিমান ঢাকা ত্যাগ করেছে। রাজধানী ঢাকায় নিরীহ মানুষেরা যখন ঘরে ফিরেছে, তখনই তাদের হত্যার জন্য পথে নেমে আসে পাকিস্তান আর্মির ট্যাংক। সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং এরপর একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এর চারপাশ, ধানমন্ডি, পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতরসহ রাজধানীর সর্বত্র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকার বাইরে হত্যাযজ্ঞ চালায় চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও। রবার্ট পেইনের মতে, অভিযানের প্রথম রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামে। নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিদের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানিরা এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। রাতের অন্ধকারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, সবার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাঙালিদের প্রতিহত করার। এই পরিকল্পনা উল্টো প্রতিক্রিয়া করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অন্যতম ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর জে রুমেল। তিনি তাঁর ডেথ বাই গভর্নমেন্টস বইতে লিখেছেন, ‘ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আধা সামরিক বাহিনীগুলো প্রতি ২৫ জন বাঙালির একজনকে হত্যা করেছে। যার সবচেয়ে কদর্য ও কুৎসিত চেহারা দেখা গেছে একাত্তরের ২৬৭ দিনে’। তাদের এই নৃশংসতার কারণে আরও সুসংগঠিত হয়ে শাসকদের প্রতিহত করার কাজটি আরও ত্বরান্বিত করেছে। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রæ বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহŸান জানান।বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামক এক নতুন রাষ্ট্রের।
এত ভয়াবহ ও গণবিধ্বংসী গণহত্যা খুব কম দেশেই হয়েছে। এত কম সময়ে এত বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়তো আর কোনো দেশে হয়নি। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের The Convention on the Prevention and Punishment of the Crimes of Genocide বা জেনোসাইড কনভেনশনে- কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া এই পাঁচটি অপরাধের যেকোন একটি অপরাধ সংগঠিত হলে তাকে গণহত্যা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। অথচ একাত্তর সালে বাংলাদেশে বর্বর পাকিস্তানিদের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যায় উপরের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটিই সংঘটিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ এখনো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হয়নি, উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে শহীদের সংখ্যা নিয়েও নানান ইতিহাস বিকৃতি, অপপ্রচার-অস্বীকার সহ ঠাট্টা তামাশা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলেছে, শহিদ ও নির্যাতিতের সংখ্যা নিয়ে চলছে দেশি-বিদেশি অপপ্রচার। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো পরিবার কান্না মুছে দেয়া যাবেনা, নির্যাতিতা নারীর সম্ভ্রম হয়ত ফিরিয়ে দেয়া যাবেনা, সে সময়ে ভিটে-মাটিহীন হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া শরণার্থীদের দগদগে কষ্টের স্মৃতি হয়ত মুছে দেয়া যাবে না কিন্তু সেদিনের সেই ভয়াল অপরাধের স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানুষের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রদান করবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবহিনী কর্তৃক এই বর্বরতাকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানাই। জয় বাংলা।

লেখক; প্রাবন্ধিক, সংগঠক