মুক্ত ফুটপাত প্রত্যাশা-এভাবেই থাকুক

3

এমরান চৌধুরী

রাস্তায় যখন হাঁটতে বেরোই তখন মনের ভেতর একটা প্রশ্ন প্রায়ই উঁকি মারত-ফুটপাত তুমি কার? কিন্তু উত্তরটা কার কাছে চাইব অনেক ভেবেও কূলকিনারা করতে পারিনি। রাস্তায় বেরোলে ফুটপাতের হালহকিকত দেখে যে কারও মাথা গরম না হয়ে পারে না। অত্যন্ত ঠাÐা মেজাজের মানুষও এ অবস্থায় বিরক্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। ফুটপাতের অবৈধ দখলদারিত্ব নিয়ে হরহামেশাই পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়ে আসছিল। উপসম্পাদকীয় থেকে সম্পাদকীয়, এমন কি নিউজ হেড লাইনও হয়েছে বারবার। কিন্তু সমস্যাটি নিরসনের দু’একবার চেষ্টা করা হলেও তার সুফল নগরবাসী পায়নি। দু’একদিন ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেলেও সপ্তাহ গড়াতেই দেখা গেছে আবার সদর্পে পসরা সাজিয়ে বসেছে হকাররা। এবার যেন অতীত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয়। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা চাইব ফুটপাত ফুটপাতই থাকুক। এটা অবৈধ ব্যবসার জায়গা না হোক। গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম শহরকে নতুন রূপে দেখতে পাচ্ছি। অনেকদিন ধরে যেটা মনের গহিন ভিতর পুষে আসছিলাম, অনেকটা তাই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে ও স্থানীয় কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় ফুটপাত দখল করে জনগণের ভোগান্তি ঘটিয়ে যারা ব্যবসা করে আসছিল তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। নগরবাসীর জন্য এটা অত্যন্ত সুসংবাদ এবং এজন্যে মাননীয় মেয়র মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম শহরের দু একটা সড়ক ছাড়া এমন কোনো সড়ক নেই যেখানে ফুটপাত অবৈধ দখলে নেই। কোনো কোনো রাস্তায় ফুটপাতের সমস্ত অংশ জুড়ে থাকে হকার আর তার পসরা। শুধু ফুটপাত নয়, ফুটপাত ছাড়িয়ে যানবাহন চলাচলের জায়গায়ও চলে আসে এসব অবৈধ দখল। কোথাও মাছের বাজার, কোথাও তরিতরকারি, কোথাও ফলমূল, কোথাও জামা-কাপড়, কোথাও নেহেরি, কোথাও তেহেরি, কোথাও জুতা-সেন্ডেল, কোথাও শুটকি, কোথাও পেঁয়াজ-রসুন, কোথাও চায়ের দোকান। শীতকাল এলে এসবের সাথে যুক্ত হয় মোয়া-মুড়ি, ভাপাপিঠা আরও কত কী! চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ফুটপাত থাকে হয় দোকানদারের দখলে, নয়তো হকারের দখলে। প্রশাসন যে এসব দেখেন না কিংবা এসব অবৈধ দখলের ওপর যে তাদের নজরদারি নেই তা বলা যায় না। মাঝে মাঝে এসব দখলদারের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতো উচ্ছেদ অভিযান। তবে তাদের পরিচালিত অভিযানের সুফল নগরবাসী বড়জোর এক দুইদিনের বেশি পেত না। দিন গড়িয়ে আবার সূর্য ওঠলেই দেখা যায় সে একই হাল হকিকত।
ফুটপাত মানে কী আর রাস্তা মানে কী—এদুটো শব্দের অর্থ বোঝেন না এমন মানুষ বোধ হয় নগরে নেই। ফুটপাত হচ্ছে নাগরিকের হাঁটার পথ আর রাস্তা হচ্ছে যানবাহন চলালের পথ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের শহরে আমাদের নগরে ব্যস্ততম সড়কগুলোতে ফুটপাতের চিহৃও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা পায়ে হেঁটে স্কুল-কলেজে যায়, কিংবা কর্মস্থলে যাতায়াত করেন তাদের পড়তে হয় নানা অসুবিধায়। ফুটপাত না থাকায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যে কোনো সময় দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সে সঙ্গে হাঁটার ধীর গতির কারণে অনেকে সময়মতো স্কুল-কলেজে, বড়রা কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেন না। একারণে স্কুলের শিক্ষার্থীদের যেমন বকুনি খেতে হয়। তেমনি বড়দেরও কর্মস্থলে কৈফিয়ত তলবের মুখোমুখি হতে হয়। কর্মস্থলে অনেকেই বিলম্বের কারণ হিসেবে যানজটের কথা বলে থাকেন। কিন্তু এই যে যানজট তার জন্য বেশির ভাগই দায়ি ফুটপাত অবৈধ দখলে থাকা। আবার নগরীর বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেন, স্কুল-কলেজ, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় বড় রাস্তার পাশে অবস্থিত। সেগুলো যখন ছুটি হয় কিংবা অফিস-আদালত শুরু বা ছুটির সময় সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এ অসহনীয় যানজটের মূলে রয়েছে রাস্তার একাংশ এবং ফুটপাতের অবৈধ দখল।
ফুটপাতের অবৈধ দখলদারিত্বের কারণে শুধু যে পথচারীদের যাতায়াতে অসুবিধা হয় শুধু তাই নয়। প্রথমতঃ ফুটপাতে ব্যবসার কারণে মূল দোকানদার, যারা লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে দোকান নিয়েছেন তারা বিষমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। তাদের দোকানে স্বাভাবিকভাবে ক্রেতারা প্রবেশ করতে পারেন না। ক্রেতাদের অবাধ যাতায়াত বিঘিœত হওয়ার কারণে অনেক দোকানদার নানাভাবে লোকসানের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। দ্বিতীয়তঃ অবৈধ দখল থেকে সৃষ্টি হয় যানজট, যানজট থেকে বায়ুদূষণ,শব্দ দূষণ সর্বোপরি কার্যসময়ের অপচয়। যানজটে আটকা পড়ে একজন সুস্থ মানুষ যে কোন সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। একদিকে যানজটজনিত কালোধোঁয়া, অবিরাম গাড়ির হর্ণ, তারমধ্যে যদি এম্বুলেন্সের গগনবিদারী আওয়াজ শুরু হয় তখন যানজটটা পরিণত হয় সাক্ষাৎ নরকে। এ অবস্থায় উচ্চচাপের রোগীদের রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, ক্রনিক হাঁপানি রোগীর হাঁপানির মাত্রা বাড়তে পারে। গাড়ির কালো ধোঁয়ার সঙ্গে ধুলোবালি আর বাতাসে উড়ে বেড়ানো রোগ জীবাণু গাড়িতে আটকা পড়া মানুষের পাশাপাশি পথচারী, পাশের দোকানদার এবং স্কুলগামী বা স্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের আক্রমণ করতে পারে। যানজটের কারণে আশেপাশের এলাকার বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। এ বায়ুদূষণের অনায়াসে ছড়িয়ে পড়তে পারে বায়ুবাহিত নানা রোগ। য²া, হাঁপানী, শ্বাসরোগের মতো মারাত্মক রোগসমূহের বিস্তৃতি ঘটে দূষিত বায়ুর মাধ্যমে। বায়ুদূষণের পাশাপাশি যানজটযুক্ত এলাকায় অতিমাত্রায় শব্দদূষণ ঘটে। যিড় -এর মতে মানুষের কাছে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৬০ ডেসিবল। এর ওপরে গেলেই সে শব্দ আর বাঞ্ছিত থাকে না, হয়ে পড়ে অবাঞ্ছিত। যানজটকবলিত এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা এতই বেশি হয় যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সঙ্গে অনেকগুলো গাড়ির হর্ণ বেজে ওঠে। এই কর্কশ শব্দে মানুষের প্রাণ যে কেমন হয় তা ফুটে ওঠেছে নিচের ছড়াটিতে—যানজটে আটকা পড়ে/ জাটকা মাছের মতো/ বুকের ভেতর অচিন পাখি/লাফায় অবিরত। আমরা জানি, শব্দের মাত্রা ৮০ ডেসিবল হলে সাময়িকভাবে বধির এবং ১০০ ডেসিবল হলে একেবারে কালা হবার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না নিজেদের উৎপাদিত শব্দের মাধ্যমে নিজেদের কী ক্ষতি করছি, চারপাশের মানুষের ক্ষতির কারণ হচ্ছি। মোটরের হর্ণে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তার মাত্রা ৯৫ ডেসিবল, ট্রাকে ও বাসে হয় ৯২ থেকে ৯৪ ডেসিবল। ব্যান্ড মিউজিকে ১৩০ ডেসিবেল। তাহলে দাঁড়ালো কী? একজন মানুষ যেখানে মাত্র ৬০ ডেসিবল শব্দ শোনার ক্ষমতা রাখে সেখানে তাকে প্রায়ই অতিরিক্ত মাত্রার শব্দ তথা সন্ত্রাসের মধ্য দিযে কাটাতে হচ্ছে এক একটা দিন। আর যানজটজনিত কারণে দেশের মানুষের কী পরিমাণ কর্ম ঘণ্টা প্রতিদিন অপচয় হচ্ছে তা সঠিকভাবে নিরুপণ করা সম্ভব নয়।
কাজেই আমাদের সবার মনে রাখা দরকার, ফুটপাত পথচারীদের, ব্যবসা বা অন্য কিছু করার জায়গা নয়। ফুটপাত থেকে হকার বা অবৈধ দখলদারদের তুলে দিলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তারা পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্ট পাবেন এ রকম মানবিক বিবেচনাবোধ কারও মনে থাকা ভালো। তবে এজন্য বছরের পর বছর অন্যায়কে আশকারা দেওয়া মানে বড় ধরনের অন্যায়ের সামিল। কারণ ফুটপাতে অবাধ চলাফেরার সুযোগ নিঃসন্দেহে নাগরিক অধিকার। কোনো অজুহাতেই নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। তাই বৃহত্তর কল্যাণ, সবার জন্য অভিন্ন সুযোগ ও আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রয়োগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক