মুক্তির পথ একটাই!

17

বাবুল কান্তি দাশ

চেতনার ‘চৈতন্য হোক’। কিন্তু এই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এসেও একটা প্রশ্ন প্রায়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, সত্যিই চৈতন্য হয়েছে কি আমাদের? না হলে এখনও কেন অন্ধ মানসিকতা থেকে আমরা কেউই বেরোতে পারছি না?কেন বার বার করে বোঝানোর দরকার হয়ে পড়ে যে, আমরা মানুষ, কোনও বন্য প্রাণী নই? পথের খোঁজ না পেয়ে শুধুই ভুল পথের সন্ধানে ছুটে চলছি ঘোরগ্রস্তের মতো। আসলে, সমাজের ভিতরে পচন ধরে গিয়েছে অনেকদিন। রোগ দানা বেঁধেছে মনের গভীরে। ফলে, খুব সহজেই আমরা বিচার করে ফেলছি মানুষকে নিজের ভাবনার মাপে। অন্ধকার অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বর্তমানের সময়কে বিচার করছি। মানুষের বিচারও করে ফেলছি খুব দ্রæত। যেখানে আমাদের মনন প্রভাবিত হচ্ছে ধর্মান্ধতার অশুদ্ধতায়। আমরা বহুভাবেই ধর্মভিত্তিক সমাজের চিত্র আঁকছি। এর বহুবিধ সংকট নিয়েও কথা বলছি। আরো অসংখ্য চিত্র ও সংকট রয়েছে। আমরা চাই এর থেকে উত্তরণ। একটা ভাল উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে। যে মৌলবাদ শব্দটি এসেছে খৃষ্ট ধর্ম থেকে, যে খিস্টানরা ধর্মোন্মাদ হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাদের তাÐবে বহু জনপথ, মানুষ ও বিজ্ঞানচিন্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। সেই ইউরোপ, সেই খিস্টান সমাজ আজ মৌলবাদ মুক্ত হয়েছে। ইউরোপে প্রথমে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আসে রেনেসাঁ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী হল ইউরোপের মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পনের মধ্যবর্তী সময়। এটাই রেনেসাঁকাল। যদিও এটি শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং শেষ হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে। রেনেসাঁর আগে অন্ধকার যুগে ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল, আজকের দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মতোই। স্বাধীন ও মুক্তচিন্তা রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অন্ধকার যুগ অবসানের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পÐিতগণ আশ্রয় নেন ইতালিতে এবং তাদের প্রচেষ্টায় ইতালিতে শুরু হয় জাগরণ।এরপর নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয় ইতালি হয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগিজ, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ইত্যাদি ইউরোপীয় দেশে। রেনেসাঁ একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ঘটে শিক্ষার পুনরুত্থান। গির্জা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদান শুরু হয়। মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। এতে পড়াশোনা ও বই-পুস্তক অধ্যয়নেও বিপ্লব ঘটে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ বদলে যেতে থাকে। একারণে মানবতাবাদী বোকাচ্ছিও ও পেত্রার্কসহ শিল্পী-সাহিত্যিকদের কৃতিত্ব দেয়া হয়। রেনেসাঁ প্রথার বিকাশ, বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিনির্ভরতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, কোপার্নিকাস, ব্রæনো, গ্যালিলিও, নিউটন বিস্ময়কর অবদান রাখেন পরিবর্তনে। নতুন সাহিত্যের বিকাশ রেনেসাঁ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আরো ভূমিকা রাখেন চারণ কবিগণ। কবি দান্তে সাহিত্য রচনার নতুন ভাষা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যান্ডে চসার আধুনিক ইংরেজি ভাষার প্রকৃত রূপদান করেন। রেনেসাঁ গতি পায়। ইউরোপের মানবতাবাদী পÐিতরা মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করেন এটাকে জীবনের লক্ষ্য বিবেচনা করে। ধর্মভিত্তিক চিন্তার বাইরে তারা উদার, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। প্লেটো ও হোমারের রচনা তরুণদের আন্দোলিত করে। ইতালির শতশত তরুণ প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষা ছেড়ে দিয়ে পেত্রার্কের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানে যুক্তিবাদের ধারার সৃষ্টি হয়। তরুণদের মনে নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা জেগে ওঠে। মধ্যযুগের শিল্পকলার বিষয় ছিল ঈশ্বর ও যিশু।কিন্তু মানবতাবাদী শিল্পীরা বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন মানুষকে। তারা শিল্পে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা ফুটিয়ে তুলেন। শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সমাজ বদলে বিপুল ভূমিকা রাখেন। এই ধারা অব্যাহত ছিল। ভলতেয়ার, রুশোদের প্রভাবে ঘটে ফরাসী বিপ্লব। এ বিপ্লব ক্ষণস্থায়ী হলেও এর বিপুল প্রভাব পড়ে সমাজে। মানব ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এটি সামন্তবাদের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিয়ে এসেছিল।আমাদের জন্যও সেই একই পথ।ধর্মভিত্তিক সমাজকে বিনির্মাণ করতে হবে।উদার, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তৈরি করতে হবে। সরকারের পরিবর্তে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যুক্তিবাদের ধারা তৈরি করতে হবে। তরুণদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা।এসব পরিবর্তনের জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। শত শত কণ্ঠস্বর থাকতে হবে কথা বলার জন্য।যে কথায় ইউরোপ পেরিয়ে এসেছে অন্ধকার যুগ, সে কথাই আমাদের জাগরণ ঘটাবে।ইউরোপ যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারব না।এখন সময় আমাদের।প্রয়োজন যথার্থ মনোনিবেশ। মেধার পরিচর্যা ও বিকাশ। এ বড়ই কঠিন সময়।অন্ধকার চারিদিক। ধর্মান্ধতার আফিম যদি উন্নয়ন সমৃদ্ধির গতিশীল বাংলাদেশকে বুঁদ করে রাখে,তা হলে মৌলবাদ সর্বক্ষেত্রেই প্রভাবিত হবে আর এটাই স্বাভাবিক। হিংসা আর প্রতিহিংসা প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেবে আমাদের,আমরা নিজেরাই কতটা অসহায়!পরবর্তী প্রজন্মের হাতে রেখে যাব শুধুই একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ? ধর্মের দিশা আমরা চিনিনি। বেছে নিয়েছি বিশৃঙ্খলা।খুব কাম্য ছিল? উত্তর কিন্তু দিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই। দায় শুধু মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায় এড়ালে হবে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল বা তথাকথিত সা¤প্রদায়িক দল কেউ দায় এড়াতে পারে না। কারণ, জনমন প্রভাবিত করার ক্ষমতা তাদের হাতেই। রবীন্দ্রনাথও ধর্মকে অবলম্বন করেছিলেন মানবমুক্তির উৎস এবং আধার হিসেবে। তাঁর মতে, ধর্ম মানেই মানবধর্ম। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়। ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব। যাঁরা এই ধর্মের এই মূল কথা মানেন না, তাঁরা আর যাই হোক মনুষ্যত্বের বোধ নিয়ে এই পৃথিবীতে জন্মাননি। ধর্মের ধর্ম মানুষের অনিষ্ট করা নয়। কিন্তু এখন সময়টাই অন্য রকম। সহজ কথা যায় না বোঝা সহজে!বোঝার মানসিকতা নিয়ে সবাই এখন আর মানসিক ভাবেই প্রস্তুত নন। এটাই দুঃখের!যে কোনও মৌলবাদ সমাজ এবং সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে সব সময় ব্যাখ্যা করতে চায়। তার ফলে সমস্যার গতিপ্রকৃতি সব সময় হয়ে ওঠে একমুখী। বিস্তার লাভ করে মতের বিভিন্নতা আর বিদ্বেষ। আমরা বুঝেও তা বুঝতে চাই না। মৌলবাদ এবং ফ্যাসিজিম গণতান্ত্রিক মোড়কে মিলেমিশে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে, যার থেকে মুক্তির উপায় সহজে পাওয়া কঠিন। সাধারণ জনগণ এই ধরনের মৌলবাদী আচরণে তিতিবিরক্ত। সব ধর্মের মৌলবাদ যেন চেপে বসেছে আমাদের এই দেশে। সংযম, নিয়ন্ত্রণ উবে গেছে তাদের আচরণে। একুশ শতকে আমরা দাবি করি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের, অথচ মানসিকতার বিচারে এখনও আমরা অন্ধকারবিলাসী। ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’র দিশা আমাদের অভিভাবকই দিয়েছেন। আমরা গ্রহণ করলাম না!আমরা বিশ্বাস করলাম না যে – ‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’!
প্রকৃত শিক্ষা পারে আমাদেরকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে। ধর্মান্ধতা থেকে ধার্মিকতায় উন্নীত করতে। আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক, তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। প্রকৃত শিক্ষা আমাদের মানসলোক’কে করে আলোকিত, চিত্তকে করে প্রসারিত। শিক্ষার ব্যাপ্তির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা প্রয়োজন।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ভিতরে ও বাইরে নিত্যদিনের অস্থিরতা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী।শিক্ষায় অপরাধমূলক কার্যকলাপ,অন্ধ প্রতিযোগিতা, অসহিষ্ণুতা, এ সব সামাজিক ব্যাধিও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।ধার করা শিক্ষা নয় প্রয়োজন মৌলিক শিক্ষার।যা হবে আমাদের পরিবেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বিশ্বমানের।এর উদ্দেশ্য হবে সরকারি চাকুরে বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কেরানি প্রস্তুত না করে সার্বিক মানুষ তৈরি করা এবং তা হতে হবে মাতৃভাষায়। মাতৃভাষায় শিক্ষা দান করলে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিধর্মিতা তৈরি হবে, জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়বে, তারা নৈতিকতার প্রতি আকৃষ্ট হবে। শিক্ষা মেধাশক্তির উৎকর্ষ ঘটায়।মেধাশক্তিই মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। আদিকাল থেকে মানবজাতি মেধাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অন্যান্য প্রাণীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে। মানবজাতির মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় মেধাশক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে দেখা যায়, পৃথিবীতে যে জাতি শিক্ষায় যত বেশি অগ্রগামী, সে জাতি মেধাশক্তিতে তত বেশি বলীয়ান। তাই সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্তির একটাই পথ আর তা হলো প্রকৃত সুশিক্ষা প্রদান, তা’তে মনোনিবেশ করা, আত্মনিয়োগ করা। সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত হই এবং তার বিস্তরণে সচেষ্ট থাকি, তাহলে মুক্তি আসবে সকল ক্ষেত্রে।
লেখক : প্রাবন্ধিক