মুক্তিযোদ্ধা পপ সম্রাট আজম খান

61

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে আজম খানকে খুঁজে পাওয়া যায় এইভাবে- ‘২০ আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’ সেই মুক্তিযোদ্ধা ও ‘পপস¤্রাট’ আজম খানের জন্মদিন চলে গেল ২৮ ফেব্রæয়ারি। ১৯৫০ সালের এইদিনে তিনি পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন। নীরবে নিভৃতে চলে গেল দিনটি। আজম খান ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনির ১০নং ভবনে জন্ম নেন। তার পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। বাবা আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও মা জোবেদা খাতুন। তারা চার ভাই ও এক বোন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ছিলেন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য। ১৯৭১ সালে তিনি সেক্টর- ২ এর প্রধান বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এর অধীনে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। দুই নম্বর সেক্টরের একটি সেকশনের ইনচার্জ ছিলেন। সেকশন কমান্ডার হিসেবে ঢাকা এবং আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন তিনি।
আজম খান যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে সংঘটিত ‘অপারেশান তিতাস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন আগরতলার ক্যাম্পগুলোতে প্লাটুন কমান্ডার আজম খানের গণ সংগীত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করতো। মুক্তিযুদ্ধের পর তার সংগীত পিপাসু মন থেমে থাকেনি। অস্ত্র ছেড়ে গান নিয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েন একজন আজম খান। বাদ্যযন্ত্রে হারমোনিয়াম, তবলার পরিবর্তে গীটার, ড্রাম, ট্রাম্বুরিন ইত্যাদি নতুন ধরণের যন্ত্র সংযোজন করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশে নতুন ধারার সঙ্গীতের প্রবর্তক তিনি। তাঁর নতুন ব্যান্ড দল ‘উচ্চারণ’ দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭২ সালে বন্ধু নিলু আর মনসুরকে নিয়ে ব্যান্ডের অনুষ্ঠান শুরু করেন। ঐ বছরেই নটরডেম কলেজে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর প্রথম মঞ্চে গাওয়ার সূচনা হয়। সেই দলে ছিলেন শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ, ড্রাম বাদক আশফাকুর রহমান, গিটার বাদক ইশতাকুর রহমান। সেই সময় গানে নতুন যন্ত্র সংযোজন নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। আজম খানের যুক্তি ছিল একতারাও তারের গিটার ও তারের। আর গিটারে বাজানো গান যদি ভালো হয় দর্শক গ্রহণ করে তাহলে কেন গানে গিটার বাজানো যাবেনা। এটাতো নিষিদ্ধ যন্ত্র নয়। তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি আইয়ুব বাচ্চু সেটি প্রমাণ করে গিটার নিয়ে ‘এই রূপালী গিটার’ গান গেয়ে কিংবদন্তি হয়ে ওপারে চলে গেছেন। শ্রোতাদের মনে স্থান করে নিয়েছে গিটার। সার্থক স¤্রাট আজম খান। ১৯৭২ সালে অর্থাৎ ওই বছরই তার ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি বিটিভিতে প্রচারের পর ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতে ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’। ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলেনা’ গানগুলো প্রচারিত হলে সেগুলো তখনকার তরুণ সমাজ মুখে আড্ডায়, রেস্তোরাঁয় অনুরণিত হয়। বিটিভিতে প্রচারিত তাঁর গান ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে’ শিরোনামের গানটি সাধারনের কাছে প্রশংসিত হয়।
আজম খানের গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আমি যারে চাইরে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘একসিডেন্ট’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ পাপী আমি তাতো জানি, ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। ১৯৮২ সালে ‌‘এক যুগ’ নামে তার প্রথম ক্যাসেট বের হয়। তার গাওয়া গানের প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের প্রযোজনায়। আজম খানের বেশিরভাগ গানই ছিল ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। সাধারণ পল্লীগীতি, লোকগীতি, মারফতি, মুর্শিদি এধরনের লোকজ গানগুলোর তাল, লয় কিছুটা ভেঙে পাশ্চাত্য গায়কীতে তিনি ও তাঁর দল গান পরিবেশন করতেন।আজম খানের বেশিরভাগ গানই ছিল আধ্যাত্মিক ভাবধারার। তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন হাইকোর্টের মাজারের নুরা পাগলা। (বিচিত্রা- ১০ আগস্ট ১৯৭৩)। তাইতো তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘোরে কজনা আসল ফকির, প্রেমের ও মাজারে কত প্রেমিক ঘোরে কজনা আসল প্রেমিক। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবেনা রে’ পাপী আমি তাতো জানি বুঝেও বুঝিনা ‘এই যে দুনিয়ায় মানুষ আর মানুষ নাই’ এই আধ্যাত্মিক ভাবধারার গানগুলো যুগে যুগে শ্রোতার মনকে আলড়িত করবে। কমলাপুরের বাসিন্দা সাদাসিধে এই মানুষকে কাছ থেকে দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েকজন পথ শিশু নিয়ে হাঁটতেন আর ওদের সাথে আলাপ করতেন। বলতেন ওরা আল্লাহর কাছের প্রতিনিধি। তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, ‘আলাল ও দুলাল… আলাল কই…’।
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন সংগীত শিল্পী ও যোদ্ধা (কেননা দেশে তিনি নতুন ধারার সংগীত প্রবর্তন করেছেন), যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশে নতুন সংগীত দিয়ে তরুণদের উজ্জীবিত করেছিলেন, পরবর্তীতে এই ভুবনে ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজ, নাজমা জামান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, আইউব বাচ্চু, জেমস সহ অনেক শিল্পীর উত্থান। ২০১৯ সালে তিনি শিল্পকলা (সংগীত) এ মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। মুক্তিযোদ্ধা এই শিল্পী আজীবন মানুষের শিল্পী হিসেবে মানুষের মাঝে চির জাগরুক থাকবেন।
লেখক: ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক