মুক্তিযোদ্ধা কেষ্ট

43

 

সময়টা উনিশশো একাত্তরের মাঝামাঝি। পদশে তখন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধ অন্যায়-অত্যাচার,শোষণ-নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য। বাংলার সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য এ যুদ্ধ। প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রæমুক্ত করতে মরিয়া বাংলার জনগন।

দশ বছরের ছেলে কেষ্টর খুব ইচ্ছা যুদ্ধে যাবার। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে বলেছে। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় কেউ তাকে যুদ্ধে নেয় নি। সারাক্ষণ সে ভাবে যুদ্ধে যাবে দেশকে শত্রূমুক্ত করবে।

কেষ্ট সেদিন সদাই আনার জন্য খাসকান্দি মোড়ের দোকানে যাচ্ছিল। মোড়ের পাশে বটগাছ। তার সামনেই কালাম ভাইয়ের মুদির দোকান।

দোকানের কাছে যেতেই পাকিস্তানি মিলিটারির একটা গাড়ি হাজির। গাড়িটি দেখেই ভয়ে গা কাঁপছে কেষ্টর। দৌড় দিলে গুলি করবে তাই তা করল না। গাড়িতে থাকা লম্বা মোচ ওয়ালা এক পাকিস্তানি সৈন্য বললো-

বলিয়াকান্দি শহর কিসকা দিক হে? হামারা শহর ছে যাতি হো।

গাড়ির সামনে থাকা এক বাঙালি মুখ বের করে বলল-
উনি বলেছেন-
বালিয়াকান্দি শহর কোন দিকে? আমরা শহরে যাবো।

কেষ্টর বুঝতে বাকি রইল না, এই বাঙালি একজন রাজাকার। পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে উর্দু ভাষা শিখিয়েছে। তাই সে বাংলা এবং উর্দু দুটিই পারে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে থেকে তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার বাড়ি হয়তো অন্য এলাকায় তাই সেও ভালোমত পথ চেনে না।

কেষ্ট চিন্তা করল আজ পাকিস্তানি মিলিটারিদের উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। আজ কিছু একটা করতেই হবে।

কেষ্ট উত্তর দিল, “ঐ যে ব্রিজ দেখা যায়, ঐ ব্রিজের বাম দিকের রাস্তা দিয়ে সোজা যেতে থাকবেন। তাহলে খুব সহজেই বালিয়কান্দি শহর পেয়ে যাবেন।”

পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে থাকা রাজাকারটি বললো-
ইস লারকা কো বোলেগা, সামনেকা ব্রিজছে বাম দিককা।
এই ছেলে বলেছে, সামনের ব্রিজ থেকে বাম দিকের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।

গাড়িতে থাকা আরেকজন উর্দুতে কি যেন বলল। তারপর গাড়ি নিয়ে ব্রিজের দিকে গেল।

কেষ্ট এবার ভাবল, দ্রুত এ খবরটা সবাইকে দিতে হবে।
দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে সবার কাছে খবরটা দিল।

কেষ্টর কথা শুনে সবাই সিদ্ধান্ত নিল এখনই উপযুক্ত সময় মিলিটারিদের ঘায়েল করার।

কারন কেষ্ট যে পথ দেখিয়ে দিয়েছে ঐ পথে মিলিটারিরা শহরে যেতে পারবে না। ওটা বিলে যাবার রাস্তা। সামনেই ছাই ভাঙা বিল। এখন বর্ষার মৌসুম। বিল ভরা পানি।

দেরি না ঝটপট লুঙ্গি কাছা দিয়ে আর মাজায় গামছা বেঁধে বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন দলু, নিলু, ফেলু এবং সিরাজ কাকা।
কোথা থেকে যেন খালি গায়ে হাফ প্যান্ট পড়ে কাঁধে বন্দুক নিয়ে দৌড়ে এলেন মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক এবং মোখলেস ভাই। তার দুজনেই টগবগে যুবক এবং ভীষণ সাহসী।
এসেই জিজ্ঞেস করলেন-
মিলিটারিরা কোথায়?
কেউ দেখেছ?
তাদের ক্ষিপ্ত চোখে জ্বলজ্বল করছে প্রতিশোধের আগুন।

কেষ্ট উত্তর দিল-
আমি দেখেছি।
তুমি দেখেছ? জিজ্ঞেস করলেন সিদ্দিক ভাই।
কেষ্ট বললো, হ্যাঁ দেখেছি। তারপর সবকিছু খুলে বললো।

কেষ্টর কথা শুনে তারা এক নিমিষেই সব পরিকল্পনা করে ফেললেন। তাদের দেখে এলাকার কুড়ি-পঁচিশজন দৌড়ে এলেন।

“দ্রæত অপারেশনে যেতে হবে, সময় খুবই কম” বললেন মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক ভাই।

মুক্তিযোদ্ধা মোখলেস ভাই বললেন, কেউ খালি হাতে যাবেন না। কিছুনা কিছু সঙ্গে নিতেই হবে।

কেউ নিলেন বর্শা, কারও হাতে বাঁশের লাঠি। সবাই কিছু না কিছু সঙ্গে নিলেন।

মোট লোক হলো চল্লিশ জনের মতো। সবাইকে দুটি দলে ভাগ করা হলো।
একটির নেতৃত্ব দিবেন সিদ্দিক ভাই। অন্যটির নেতৃত্বে মোখলেস ভাই।

কেষ্টকে তারা সঙ্গে নিল না। তবুও সে জিদ করেছে আজ তাদের সাথে যাবেই। পিছন পিছন হাঁটতে লাগল কেষ্ট।

খুব সতর্কতার সাথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর দল। দুটি দল দুই পথ ধরে এগোচ্ছে। এটা মোখলেস ভাইয়ের পরিকল্পনা। কারন মিলিটারিরা একটি দলকে আক্রমণ করবে। তখনই পেছন থেকে মুক্তিবাহিনীর অন্য দলটি মিলিটারিদের আক্রমণ করবে। মিলিটারিরা প্রস্তুত হতে পারবে না। তখন মিলিটারিদের ঘায়েল করা সহজ হবে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে না এগোলে ওদের ভারী অস্ত্রের সাথে আমরা পারব না।

মিলিটারিদের গাড়ি তখন রাস্তার শেষ প্রান্তে। আর সামনে যাবার উপায় নেই। কারন সামনে বিশাল বড় ছাই ভাঙা বিল। এত বড় বিল দু-চার জেলার মধ্যে আর নেই। মিলিটারিরা বুঝতে পেরেছে যে রমিজ তাদের বোকা বানিয়ে ভুল রাস্তায় পাঠিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে ভালভাবে দেখছে অন্য কোন পথ আছে কিনা। কিন্তু না, আর কোনো পথ নেই।

সুযোগ বুঝে আক্রমণ করা হলো।
প্রথমে আক্রমণ করলেন সিদ্দিক ভাইয়ের নেতৃত্বে থাকা দলটি। সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে যে একটা গ্রেনেড আছে তা কেউই জানত না। প্রথমে সেটি নিক্ষেপ করে গাড়িটি ধ্বংস করলেন যাতে মিলিটারিরা গাড়িতে চড়ে পালাতে না পারে।

শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। বিপরীত দিক থেকে মোখলেস ভাইয়ের নেতৃত্ব থাকা দলটি যেই আক্রমণ করল, মিলিটারিরা আর পালানোর পথ পেল না। মনির কাকা বর্শা নিক্ষেপ করে পা এক পাকিস্তানি মিলিটারির পা খোড়া করে দিলেন। তারপর দৌড়ে গিয়ে তার কাছের বন্দুকটি ছিনিয়ে নিয়ে সেটি দিয়ে গুলি করতে লাগলেন। মিলিটারিদের কেউ কেউ বিলের দিকে দৌড়াঁতে লাগল।
বিলের মাঝে যে সব মাঝি এবং জেলে মাছ ধরছিলেন তারা আবার সামনে থেকে ধাওয়া করলেন। অনেক মানুষ মিলিটারিদের ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে বিলের মাঝে নৌকা বা কচুরির আড়ালে পালিয়ে ছিলেন, তারাও এসেছেন।

দু’পক্ষের গোলাগুলির শব্দে পুরো এলাকা কাঁপছে। ঘন্টা দু’য়েক সময় ধরে চলল মুখোমুখি যুদ্ধ। কিন্তু আজ আর মিলিটারিদের রক্ষা হলো না। সবগুলো মিলিটারি মারা পড়ল।

কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকা রাজাকারটা ফাঁক পেয়ে পালিয়েছে। চেহারায় বাঙালিদের সাথে মিল থাকায় মুক্তিবাহিনীর কেউ আঁচ করতে পারেন নি। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না।

তারপর সবার মুখে একটাই কথা কেষ্ট কোথায়। ওর কৌশলের কারনেই আজ একটা সফল অপারেশন হলো। নইলে এই পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের এলাকায় ক্যাম্প বানাত। আমাদের এলাকা দখলে নিত।

এদিকে কিছুটা দূরে থাকা বড় বট গাছটির আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে কেষ্ট। আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে সব কিছু। যুদ্ধের গোলাগুলির মাঝে যায় নি সে। না গিয়েই ভালো করেছে। একটা গুলি এসে লাগলে কি অবস্থাই না হতো ওর।

হঠাৎ করে মনির কাকার চোখ পড়ল কেষ্টর দিকে। তিনি দৌড়ে এসে কেষ্টকে কাঁধে তুলে নিলেন। তাকে ঘিরে সবাই আনন্দ উল্লাস করলেন। এখন তাদের পরিকল্পনা নতুন কোনো অপারেশনে যাওয়ার।
দিদ্দিক ভাই বললেন, আমাদের প্রথমে ভালো একটা ঝোপঝাড় দেখে ক্যাম্প বানাতে হবে।
মোখলেস ভাই বললেন, আমাদের বাড়ি ফেরা যাবেনা। সবাইকে ক্যাম্পে থাকতে হবে। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আবারো আসতে পারে।
কেউ কেউ কেষ্ট, কেষ্ট বলে চিৎকার শুরু করলো।
ঐ দিনের পর থেকে কেষ্টকে সবাই মিলিটারি মারা কেষ্ট বলে ডাকে।