মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু সম্প্রতি রাজনৈতিক বাণিজ্য ও জামায়াতি মিশন

16

 

সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ও প্রসার ঘটাতে প্রকাশনা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। অগ্রসর ও উন্নত জাতি গঠন, জনশিক্ষার উপযোগী সহজ ও জনপ্রিয় গ্রন্থাদি প্রকাশ করার মাধ্যমে সম্ভব। গ্রন্থ প্রকাশনার সাথে শুধুই বাণিজ্যিক সম্পর্ক নয়; এর প্রভাব ও ব্যাপকতা আরো গভীরে। মন ও মননের উৎকর্ষ সাধন, সাহিত্যমনস্ক ও জ্ঞানসমৃদ্ধ আলোকিত জাতি ও সমাজ গঠনে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রন্থপাঠের আগ্রহ ও সচেতনতা বাড়াতে জনসাধারণকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা না গেলে একটি সুসভ্য সমাজ গঠন অসম্ভব।
প্রকাশনাশিল্পে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমত তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার মানুষের পাঠাভ্যাসের ওপর প্রভাব ফেলেছে। মানুষের পাঠের সময় দখল করে নিয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যম। ফলে বই পাঠকের সংখ্যা কমছে দিন দিন, ফলে গ্রন্থের মুদ্রণসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আগে যে বইটা ১২০০ কপি ছাপা হতো, এখন সেটা ৫০০ থেকে ২৫০ কপিতে নেমে এসেছে। বই বেশি কপি ছাপা হয় না বলে এর কপি-প্রতি খরচ অনেক বেশি। এ জন্য পাঠককে বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এজন্য বই বিক্রির সংখ্যাও কম। ফলে লোকে কম কেনে, বইয়ের দাম বাড়ে, আবার চড়া দামের বই কেনা পাঠকের সাধ্যেরও বাইরে।
ভালো পাÐুলিপির অভাবের কারণে বইয়ের সংখ্যা বেশি হলেও মান কম। বই ব্যবসা তেমন লাভজনক না হওয়ার কারণ হলো, ভালো লেখক ও ভালো পাÐুলিপির অভাব। ফলে ভালো বই বছরে হাতে গোনা কয়েকটি বেরুচ্ছে । খুব কম লেখকের বই এক দুই হাজারের বেশি বিক্রি হয়। একাধিক সংস্করণ তো দূর অস্ত্—।
অপরদিকে মৌলবাদী তথা স্বাধীনতাবিরোধী তথা জামায়াত-শিবির আদর্শপুষ্ট এবং তথাকথিত উগ্র ও হঠকারী বাম বিপ্লবী (!) লেখকরা সুযোগ বুঝে বই ব্যবসায় নেমে গোটা প্রকাশনা শিল্পকে অস্থির করে তুলেছে। প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় রেখে এই গোষ্ঠীটি স¤প্রতি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উপরন্তু শেখ রাসেলকে সম্বল করে রাতারাতি প্রচুর বই প্রকাশ করেছে। বইগুলো নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি করেছে। বই এর নাম ও কভারটি এমনভাবে চটকধার ও আকর্ষক করে তোলেন যে, প্রথম দর্শনে মনে হবে বইগুলো সত্যি স্বাধীনতা বা প্রগতিশীলতার পক্ষের। কিন্তু এসব বইয়ের ভেতরে কী বস্তু রয়েছে, কোন আদর্শ তুলে ধরা হয়েছে, এই বিষয়টি কেউ তলিয়ে দেখেন না। ফলে পর্দার অন্তরালে মৌলবাদী এসব লেখকরা একদিকে দেদারছে ব্যবসা করে যাচ্ছে, অপরদিকে সুযোগ মতো তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করে আমাদের আগামী প্রজন্মকে নানা বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এসব বই প্রকাশ করে একশ্রেণির স্বাধীনতাবিরোধী প্রকাশক পর্দার আড়ালে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ফলে প্রগতিশীল এবং স্বাধীনতার সপক্ষের লেখক বুদ্ধিজীবী তথা প্রকাশকরা চরমভাবে ক্ষতিগস্ত হচ্ছে।
সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা শিল্পের সঙ্কট হলোÑকাগজ, ছাপা ও বাঁধাইয়ের দাম বৃদ্ধি। তাই বইয়ের দামও অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি ফর্মা বইয়ের দাম ২৫-৩০ টাকা রাখা হচ্ছে। ফলে ১০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ের দাম দাঁড়াচ্ছে ১৫০ টাকা। এ দামে পাঠক বই কিনছে কম। ফলে যারা শুধু সৃজনশীল প্রকাশনায় সম্পৃক্ত তাদের জন্য সারা বছর টিকে থাকা কঠিন, এখানে রিটার্ন খুবই কম, সেক্ষেত্রে পাঠক বই কেনে না বলে বইয়ের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
একসময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গণশিক্ষা অধিদপ্তর সারা দেশের পাবলিক লাইব্রেরিসমূহের জন্য, গ্রন্থকেন্দ্র ও জেলা পরিষদ প্রতিবছর প্রচুর বই ক্রয় করতো। বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু বই মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ক্রয় করানো হচ্ছে। পাবলিক লাইব্রেরি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সামান্য সংখ্যক বই ক্রয় করলেও তাতে রাজনৈতিক বিবেচনা বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনমূলক, মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, সমর্থক ও আমলাদের লেখা বই ক্রয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রকাশনা ব্যবস্থায় একটা বড় সমস্যা বিপণন। বহু প্রকাশনা সংস্থা এই সমস্যার পেশাদারি সমাধানে আসতে না পেরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। মার্কেট স¤প্রসারণের নেটওয়ার্ক বাড়ানোর আকর্ষণীয় প্রক্রিয়া, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা বাজেট নেই। ফলে বইবিক্রির টাকা থেকে অথবা আলাদা ফান্ড থেকে মার্কেটিং এবং সেলসের খরচ জোগাতে পারে না।
সা¤প্রতিক প্রবণতা হলÑ নামকরা লেখক না হলে প্রকাশকরা ছাপতে চান না। কারণ অপরিচিত লেখকের বই যতই ভালো হোক না কেন, পাঠক সেদিকে তাকায় না। ফলে প্রকাশক নতুন কোনো লেখকের বই প্রকাশ করতে চান না। লেখককেই টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তাছাড়া অনেক নবীন লেখক আর্থিক লাভের আশায় বই প্রকাশ করেন না; তিনি চান পরিচিতি, খ্যাতি বা নাম যশ। যে কারণে নতুন লেখকরা প্রায়ই ব্যক্তিগত প্রকাশনা তথা অ্যাডফার্ম থেকে বই প্রকাশ করে থাকেন। তাদের এসব বই কোনো বইমেলা কিংবা অন্য কোথাও বিক্রির সুযোগ পান না। এছাড়া বিপণন ব্যবস্থার কারণে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং বিক্রির অভাবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে না পারায় আশাহত বেদনায় ভোগেন।
পক্ষান্তরে প্রকাশনা থেকে যৌথ বিনিয়োগে বই প্রকাশিত হলে চুক্তি অনুসারে বই ছাপার সঙ্গে সঙ্গে কপি বুঝে নেওয়া লেখকের জন্য সুবিধাজনক মনে করা হয়। বেশ কিছু প্রকাশক নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে গ্রন্থস্বত্ব কিনে নেওয়া হয় ৫-৬ হাজার টাকায়। স্বত্বটা প্রকাশকের কাছে ১০ বছর থাকে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে বই প্রকাশ করতে লেখককেই দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশকের ভূমিকা পালন করতে হয়। তারপরও অনেক সময় বিক্রির কাজটা পর্যন্ত লেখককে করতে হয় । এক্ষেত্রে বাকিতে লাইব্রেরিতে বই দিয়ে আসতে হয়. বই বিক্রি হলে টাকা পাওয়া যায় না।
সম্পাদনা ছাড়া বই কখনো উচ্চমানের হয় না। এদেশে অনেক প্রকাশনা সংস্থায়ই সম্পাদনার চর্চা নেই। ফলে দুর্বল বই প্রকাশিত হচ্ছে। বইয়ের গুণগত মানের দিকে কোনো মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না।
এখন অনেক প্রকাশক ও লেখক বইয়ের অ্যাপ প্রকাশ করছে। প্রকাশনা ব্যবসার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। তারপরও সম্পাদনা, (গ্রæপ পেজিনেশন, ডিজাইন), প্লেট, কাগজ, কালি ও মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ এবং বিজ্ঞাপন খাতগুলিতে অনেকে টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
সৃজনশীল ভালো প্রকাশনা অনেক ক্ষেত্রে লাভজনক হয় না। তাই পাঠ্যবই, গাইড আর টেস্ট পেপার ছাপিয়ে অনেকে টিকে থাকেন।
প্রকাশনাশিল্পের খেলার মাঠটি ইদানীং বন্ধ্যা হয়ে ওঠেছে। প্রথমা প্রকাশনা একচেটিয়া ব্যবসা করতে গিয়ে অন্য প্রকাশকদের ব্যবসা সত্যি কঠিন করে দিয়েছে। প্রথমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপন প্রথম আলোতে ছাপা হয়, অন্য কোনো লেখক বা প্রকাশকের পক্ষে তার দশ ভাগের এক ভাগও দেওয়া সম্ভব নয়।
আর একটি আশঙ্কা ও ভয়াবহ ব্যাপার হলো প্রকাশনা শিল্পে ইদানীং নব্য হাইব্রিডদের অনুপ্রবেশ। স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐ প্রসঙ্গ মূলধন করে তারা কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই লাগামহীনভাবে গ্রন্থ প্রকাশ করে যাচ্ছে। এমনকি শিশু রাসেল হত্যা যেহেতু একটি সংবেদনশীল বিষয়, তাই মাসুম বাচ্চাটিও তাদের হীন অপচেষ্টা থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু তাদের মূল মকসুদ স্বাধীনতার চেতনা সাবোটাজ করা এবং ইতিহাস বিকৃতি।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়-
স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কমপক্ষে হাজার খানেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বেশিভাগ গ্রন্থই গতানুগতিক, চর্বিতচর্বন এবং মানহীন। এতো মামুলি গ্রন্থ প্রকাশের মূল কারণ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্রয় লিস্টে সংযুক্তি তথা মুনাফা।
আরো একটি মারাত্মক ব্যাপার হলো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা জামাযাত শিবির চক্র খুব সূ²ভাবে ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার কৌশলী মিশনে তৎপর। তাদের গ্রন্থে জিয়া প্রসঙ্গ, ৫২-এ ভাষা আন্দোলনে কুখ্যাত গোলাম আযমের মহিমা কীর্তনÑকিসের আলামত তা সহজেই অনুমেয়।
তাই এখন লেখক, পাঠক, প্রকাশক, সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা সরকারের বোধোদয় হওয়া জরুরি।

লেখখ : গবেষক, লেখক ও প্রকাশক