মীর সাহেবের মীরসরাই একটি প্রাচীন জনপদ

373

সোহেল ফখরুদ-দীন

বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জনপদের নাম মীরসরাই। বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা। এ উপজেলায় ১৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। ১৯১৭ সালের ১৫ জুলাই এই মীরসরাই থানা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২১ সেপ্টেম্বর গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯১৮ সালের ১ জানুযারী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মীরসরাই থানার কার্যক্রম চালু হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গদেশ জয়ের পর বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ভারতবর্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা বঞ্চনাম বৈসম্য ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে মুসলমান ব্যবসায়ী ও সৈন্যদের সাথে মুসলিম ধর্মপ্রচারকগণ চট্টগ্রামে আগমণ করেন। তাঁদের অমায়িকক ব্যবহার, সেবাধর্মী মনোভাব, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, খোদাভক্তি ও ভীতি সাধারণ মানুষের মনে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে। এখানকার স্থানীয় মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পীর দরবেশগণ চট্টগ্রামে মসজিদ, মক্তব ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন করেন।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল করিম তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন “বাংলায় মসজিদ স্থাপনের পর থেকে মুসলমানরা একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন”। ঐতিহাসিকদের অভিমত , ১২২০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ২/২’শ বছরে যেখানে ৩ লাখ মুসলমান বসবাস করতো সেখানে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে সে সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় কোটির ওপর। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেতে এ পরিসংখ্যান আরো বেশি প্রযোজ্য। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পূর্ববাংলা ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্গম ও অধিক অনুন্নত। সড়কপথে চট্টগ্রামে আসা-যাওয়ার কোন পথ ছিল না। অসংখ্য নদী- ছড়ায় পরিপূর্ণ অঞ্চলটি বছরের পুরো সময় পানিতে তলিয়ে থাকতো। তাছাড়া চট্টগ্রাম শত শত বছর ধরে আরাকানী মগদের শাসন ছিল এবং ত্রিপুরার সাথে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। সমুদ্রপথ ও ছিল ভীতিকর। আরাকানী জলদস্যুর অত্যাচারে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ ছিল দিশেহারা। তখন চট্টগ্রাম কে কিরাত বলে ডাকা হতো। সমুদ্রতীরের কাঁচা মাছ খাওয়া লোক কে কিরাত বংস বলে উল্লেখিত। চট্টগ্রাম অঞ্চল সত্যিকার অর্থেই ছিল ‘মগের মগের মুল্লুক এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে আসেন প্রখ্যাত সুফী হযরত বদর শাহ। ইসলাম প্রচারে তিনি নিয়োজিত হন। তাঁর সাথে এসে যোগ দেন বেশ ক’জন আউলিয়া-দরবেশ, যাঁরা বার আউলিয়া নামে পরিচিত হয়। চট্টগ্রাম জেলায় ১০ টির অধিক স্থানে বার আউলিয়ার মাজারের অবস্থান রেয়েছে।
কিন্তু আরাকানী মগশাসিত চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের পরিবেশ মোটেও অনুকূল ছিল না। নানা বাধা-বিপত্তি ও অত্যাচার নির্যাতন চলেত নদী পথে পথে মুসলমানদেন ওপর। হযরত বদর শাহ (রঃ) ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে বাংলার সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ (১৩৩৮-৫০) কে চট্টগ্রামে অভিযান পরিচালনার আহবান জানান। সুলতান সে আহবানে সাড়া দিয়ে সেনাপতি কদল খানকে চট্টগ্রামে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। ঐ সময় আরাকানী সৈন্যদের বিতাড়িত করেন। গাজী উপাধিতেক ভূষিত হন সেনাপতি কদল খান। কিন্তু মুসলমানদের প্রথম চট্টগ্রাম বিজয় নিয়ে কোন ঐতিহাসিক তথ্যাদি পাওয়া যায়না। চট্টগ্রাম বিজয়ের প্রায় তিন’শ বছর পর চট্টগ্রামের কবি মোহাম্মদ খান তাঁর মক্তুল হোসেন কাব্য রচনা করেন। সেই কাব্যে নিজের বংশ মর্যাদার কথা লিখতে গিয়ে কবি মোহাম্মদ খানের জীবনী লিপিবদ্ধ করেন কবিতার চন্দে। কবি চট্টগ্রাম বিজেতা কদল খান গাজী, শায়খ শরীফ উদ্দিন ও বদর আলম অর্থাৎ হযরত বদর শাহসহ বেশ কয়েকজন ইসলাম প্রচারক মহান সাধকের নাম উল্লেখ করেন। চট্টগ্রাম অধিকারের পর এখানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং প্রচুর সংখ্যক সুফী দরবেশ আগমন করেন।
পরবর্তীতে আলা উদ্দিন হোসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল শাসন করেন লস্কর পরাগল খান ও তৎপুত্র ছুটি খান। এসময় এ অঞ্চল লস্করপুর নামে পরিচিত হয়। লস্করপুর একটি প্রশাসনিক অঞ্চল, এখানে রাজসভা ছিল , ছিল সভাকবিও। যেখানে বাংলা সাহিত্য চর্চা হতো। ছিল সৈন্যবাহিনী, সভাসদ ও প্রশাসনিক দপ্তর । সুলতানী আমলের পর চট্টগ্রামে শাসনভার চলে যায় সুর বংশের নিজাম শাহ সুরের হাতে।
তিনি জাফরাবাদে রাজ্য স্থাপন করেন। জাফরাবাদ মীরসরাই’র পশ্চিমাঞ্চলের নদী তীরবর্তী স্থান ,যা ফেনী নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে। তবে জাফরাবাদে নামে মৌজা রয়েছে সীতাকুন্ড ও মীরসরাইতে। অবশ্যই চন্দনাইশ উপজেলার সঙ্খ নদীর তীরে জাফরাবাদ নামক একটি এলাকা রয়েছে। সেটি বৈলতলী ইউনিয়নের অংশ। চট্টগ্রামের অন্যনাম জাফরাবাদ একথা জানা যায় এই রাজ্যের সভাকবি ও রাজস্ব উজির বাহরাম খানের ‘ইমাম বিজয়’ কাব্যে। এই জাফরাবাদ রাজ্যই পরবর্তীকালে নিজাম শাহের নামে নিজামপুর পরগনা রূপে প্রকাশ পায়। উল্লেখ্য যে , নিজাম শাহের রাজত্বের প্রায় অর্ধ শত বছর পর ১৬১৬ সময় থেকে নিজামপুর নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে জাফরাবাদ শহরটি ফেনী নদীতে বিলীন হয়ে যায়। গবেষক শেখ এটিএম রুহুল আমিনের মতে হনডেন ব্রকের অংকিত মধ্যযুগের একটি মানচিত্রে ফেনী সাগর সংগমে জাফরাবাদ নামে একটি বন্দরের উল্লেখ আছে ।
নিজামপুর পরগনার একাধিক জাফরাবাদ মৌজা রয়েছে। ১৮৩৭-৩৮ সালে লেফটেন্যান্ট এইচ, সিডনস ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রাম জেলা জরিপ করেন। এসময় প্রস্তুতকৃত ম্যাপে ১০টি জাফরাবাদ নাম পাওয়া যায়। তন্মধ্যে ৭ টি মৌজা বর্তমান মীরসরাইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেগুলো পরবর্তীতে সময়ে সময়ে নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে মোটবাড়িয়া , পূর্ব মিঠানালা , মিঠাছড়া, রাঘবপুর, রাজাপুর, বামনসুন্দর ও পশ্চিম মলিয়াইশ নামে নামকরণ হয়েছে। মীরসরাই নামকরণ প্রসঙ্গে, ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে আলা উদ্দিন হোসেন শাহ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ববর্তী দুই দশক দেশের পরিস্থিতি অশান্ত ছিল। এসময় চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন রাস্তি খাঁ। তাঁর পুত্র পরাগল খাঁ ও তৎপুত্র ছুটি খাঁ উত্তর চট্টগ্রামের শাসন করতেন এবং পরাগলপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। এসময় চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে ত্রিপুরা ও আরাকানী সৈন্যদের সাথে মুসলিম সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজা ধন্যমানিক্য চট্টগ্রাম জয় করেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ে গৌড়ের অধীনে চলে আসে চট্টগ্রাম। এসকল যুদ্ধে আলা উদ্দিন হোসেন শাহ কে মতান্তরে নসরৎ শাহকে সৈয়দ আলফা হোসাইনী নামক বাগদাদেন বনী হাশেমী এক বনিক যুদ্ধ নৌকা, অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। স্বয়ং সুলতানের পরিবারের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্কে স্থাপিত হয়। জানা যায়, ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আলফা হোসাইনী চট্টগ্রাম আসেন। তিনি ১৪টি বাণিজ্যিক জাহাজের মালিক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর হোসেন শাহ ( মতান্তরে নসরৎ শাহ) আলফা হোসানীকে অনেক ভূসম্পতি প্রদান করেন এবং তিনি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে বসবাস শুরু করেন। চট্টগ্রাম শহরের কাজীর দেউরীর বিখ্যাত কাজী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মীর আবদুল গণির তিনি পূর্বপুরুষ ছিলেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর সুদূর গৌড়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, চট্টগ্রামের সুরক্ষা এবং সৈন্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের থাকা এ যাতায়াতের সুবিধার্থে হোসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামে একাধিক সরাইখানা বা মেহমান খানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছা পর্যন্ত অনন্ত চারটি স্থানে সৈন্যরা বিশ্রামে থাকতেন। স্থানগুলো হচ্ছে বুড়বুড়িয়া , মীর কা সরাই, সীতাকুন্ড ও কদমরসুল। সেসময়কার ইতিহাসে উত্তর চট্টগ্রামে অনন্ত দু’টি সরাইখানার নাম পাওয়া যায় একটি মীর কা সরাই অপরটি ভাটিয়ারীতে। বস্তুত ফেনী নদী পার হয়ে একটি রাস্তা জোরওয়ারগঞ্জ হয়ে ( পরাগলপুরের ভেতর দিয়ে) মীরসরাই ও সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এটিই সেকালে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড বা ‘ফখরুদ্দীনের পথ’ নামে পরিচিত, যার অবস্থান অদ্যাবধি বিদ্যমান। মীরসরাইতে যে মেহমান সরাই প্রতিষ্ঠিত হয় তা পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয় এক সাধক পুরুষের উপর যাঁর নাম মীর সাহেব। তিনি সুফীবাদের উপর প্রভাব শালী ব্যক্তি। কেউ কেউ তাঁকে সামরিক সৈনিক বলেও অভিহিত করেছেন। এই মীর সাহেব মেহমান সরাইতে সারাজীবন অতিবাহিত করেন এবং তাঁর নামানুসারে এই সরাইখানা বা মেহমানসরাইটি মীর কা সরাই নামে পরিচিত হয়। স্কটল্যান্ডের অধিবাসী ও বৃটিশ ইন্ডিয়ার বিখ্যাত সমীক্ষক ফ্রান্সিস বুকানন ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চ তারিখে চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছেন ‘‘ বিকাল ৩টা নাগাদ আমি ফেনী বাংলো ত্যাগ করলাম। তারপর আরো ১২মাইল ভ্রমণের পর পৌঁছলাম মীর খা সরাই। যাত্রীদের জন্য এখানে ও থাকার একটি ব্যবস্থা আছে। ’’ তিনি ১১মে তারিখে চট্টগ্রাম ভ্রমণ শেষে ফেরার সময় মীর খা সরাইতে রাত্রিযাপন করেন এবং জোরারগঞ্জ হয়ে লক্ষীপুরের দিকে যাত্রা করেন। এই মীর খা সরাই বা মীর কাসরাই পরবর্তীতে মীরসরাই নামে পরিচিতি লাভ করেন যা আজকের প্রসিদ্ধ মীরসরাই।মীরসরাই থানা বা উপজেলা। মীরসরাই উপজেলা সদরের ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশেই রাস্তার সাথে হযরত মীর সাহেবের মাজার শরীফ অবস্থিত। প্রাচীন মাজারটির পরেই মীর সাহেবের নামে দিঘী রয়েছে। গত বছরের ৫ এপ্রিল তারিখে কবি আরিফ চৌধুরী, কবি অধ্যাপক রিপন চক্রবর্তীসহ মীর সাহেবের সমাধী মাজার পরিদর্শন করার সৌভাগ্য আমার হয়। ঐদিন মীরসরাই উপজেলাও ভ্রমণ করি। ইতিহাসের প্রয়োজনে তথ্যগুলোকে বিবেচনা করে একটি প্রবন্ধ রচনা করি। বর্তমান মীরসরাইয়ের সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও গ্রন্থপ্রণেতা