মিয়ানমার পরিস্থিতি, ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের আহম্মকেরা

27

কামরুল হাসান বাদল

বিএনপি ও তাদের সমমনা দল, কিছু আলট্রা বাম আর সুশীল সমাজের কারো কারো বক্তব্যে মনে হচ্ছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনই যুদ্ধ শুরু করা উচিত বাংলাদেশের। তারা প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকারকে উসকাচ্ছে, জনগণকে উত্তেজিত করছে। তাদের সমর্থকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রæপ আর ট্রলে ভেসে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এইসব মাথা মোটাওয়ালারা আহাম্মকেরা মনে করে এটা পাড়া পাড়ায় ঝগড়া বিবাদ বা দুদল গ্রামবাসীর মারামারি বা আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের লড়াই। এরা ভূরাজনীতি বোঝেন না। বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বোঝেন না। এরা যুদ্ধ কী বোেেঝন না। একদিনের যুদ্ধব্যয় কত হতে পারে সে বিষয়ে এদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই। তারা শুধু একটা জিনিস বোঝেন তা হলো যে কোনোভাবেই হোক শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানো তাতে যদি দেশ ও জাতির বারোটাও বেজে যায় তাতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।
গত কিছুদিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন জাতিসত্তার সংঘাত চলছে। অনেক স্থানে সশস্ত্র প্রতিবাদ এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধও চলছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা অস্থির হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে সে দেশের সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী। অং সান সুচির বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণার পর সেদেশে সুচির সমর্থকরা বিক্ষোভ করছে আর একই সঙ্গে সে দেশের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলন যা এখন সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সংঘাত চলছে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি যে কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সে দেশের নিক্ষিপ্ত গোলা এসে পড়ছে। এমন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সীমান্তবর্তী লোকজন নিরাপত্তার অভাবে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এরমধ্যে গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ব্রিফিংয়ে আসিয়ানভুক্ত সাত দেশের কূটনীতিকরা বলেছেন, মিয়ানমারের চলমান সংকট আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারই দায়ী। ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত না থাকলেও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রæনেই, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মিশনপ্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ে রাখাইন ষ্টেটে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সেখানকার সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের ঘুমঘুম সীমান্তের অবনতিশীল পরিস্থিতি কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে কেন? যুদ্ধ করে তো এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যা করতে হবে তা আলাপ-আলোচনা, আন্তর্জাতিক বা বিশ্বসংস্থাগুলোর সমর্থন লাভ করে করতে হবে। মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গা বিষয়টি এখন নানাভাবে বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আধিপত্য বিস্তারের একটি দাবাখেলায় পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার বন্ধুহীন রাষ্ট্র নয়। বিশ্বের বর্তমান অন্যতম পরাশক্তি চীন তার পাশে আছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন শর্তহীনভাবে মিয়ানমারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করে চীন। ভারতও এখন মিয়ানমারের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। চীন-ভারত সম্পর্কটি চিরকালের বৈরী হলেও ভারত মহাসাগরে মার্কিন আধিপত্য বিস্তার ঠেকানোর লক্ষে দুদেশের অভিন্ন অবস্থান আছে। রাশিয়ার অবস্থান এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষে বলেই মনে করা হয়। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালেই মাত্র কয়েকদিন আগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এসেছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে অনেক ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সাল থেকে বিএনপি সরকারই তো বারবার ‘আহলান সাহলান’ বলে রোহিঙ্গাদের দেশে ডেকে এনেছে প্রায়। শুরু তো তাদের হাত দিয়েই। ভুলে গেলে চলবে কি করে সে সব ইতিহাস? রোহিঙ্গাদের নিয়ে কারা রাজনীতি করেছে। কারা তাদের রাজনীতির ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে তা দেশবাসীতো ভোলেনি। বিএনপি মিত্রদল জামায়াতে ইসলামীর অর্থের যোগদানদাতা মীর কাশেম আলীর রাবেতা আল আলম আল ইসলামী ও অন্যান্য এনজিওর কার্যক্রম টেকনাফ উখিয়া জুড়ে কী ছিল তা স্থানীয়রা ভোলেনি। রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ প্রদান থেকে শুরু করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার অভিযোগ আছে মীর কাসেম আলী ও তার এনজিওর বিরুদ্ধে। কাশেম আলীরা রোহিঙ্গাদের বিপথগামী করেছে। বিনিময়ে তাদের মাথা বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকা এনে জামায়াত ইসলামীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বাভাবিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগও বিনষ্ট করেছে। বিএনপি-জামায়াতের রোহিঙ্গা-কেলেংকারী নিয়ে শত শত পৃষ্ঠা লেখা যাবে তবে তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কারণ সমাধান এখন খুঁজতে হবে আন্তর্জাতিক মহল থেকে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারত কি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে? অনেকে সন্দিহান হলেও আমি মনে করি ভারতকে তার স্বার্থে বাংলাদেশের পাশে থাকতে হবে। চীন দুই কারণে মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। প্রথমত হলো তাদের ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে যে বিশাল অঞ্চল খালি করা হয়েছে সেখানে চীন বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। দুই. ইসলামী সন্ত্রাসবাদের ভয়। উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে চীন সমস্যায় আছে। সে তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে চীন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। ঝামেলা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। কিন্তু তাতে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকে জঙ্গিবাদের মতো সমস্যাকে মোকাবেলা করছে। রোহিঙ্গা অবস্থানটা এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করবে। এই ঝুঁকি থেকে ভারতও মুক্ত থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ যে অঞ্চল এবং যে অঞ্চলে দেশের একমাত্র সমুদ্র বন্দর সেখানে যে কোনোভাবে উগ্র ইসলামী দলের উত্থান ও কার্যক্রম ভারতকেও বিপদে ফেলবে। ভারতের সাথে পাকিস্তান সীমান্ত, ভারতের সাথে চীন সীমান্ত কখনোই শান্তিপূর্ণ এলাকা নয়। সে সব এলাকায় নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে ভারতকে প্রতিদিন বিপুল অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করতে হয়। সে একই পরিস্থিতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের জন্য করা তার অর্থব্যয় ও মাথাব্যথা বাড়াবে। ভারতের স্বার্থেই এই এলাকায় শান্তি বজায় রাখা দরকার। কাজেই আমি মনে করি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো ইসলামী উগ্রবাদী দল যদি এই অঞ্চলে তাদের ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করে তার দায় ভারতকেও নিতে হবে।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখনো কোনো দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। মহামারির দীর্ঘ অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক চাপে আছে। ফলে চট করে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র্রের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রেখে, নিজেদের আত্মমর্যাদাকে ঠিক রেখে সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে হবে। এবং সে সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি যেন নতুন করে এই অঞ্চলে উগ্র ইসলামী আন্দোলনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি না করে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দ্রæতই একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট