মিয়ানমারের শরণার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যে ‘বাংলাদেশি’

31

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১৩ লাখ রোহিঙ্গা। তারা কক্সবাজার জেলার টেকনাফসহ বিভিন্ন উপজেলার ক্যাম্পে অবস্থান করার কথা থাকলেও ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে। এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও এনআইডি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে সফলও হয়েছেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। দালাল চক্রের সহায়তায় পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে দু’লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। সে দেশের দূতাবাস থেকেও পেয়ে যাচ্ছেন পাসপোর্ট। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি হিসেবেই পরিচিত।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সনাক্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেশে বিদেশে যারা পাসপোর্ট দেয়ার সাথে জড়িত তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা যায়, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশে আসা শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। তবে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গারা এসেছেন ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর পরিসংখ্যান মতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন কমপক্ষে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের একটা অংশ যে কোনোভাবেই পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সংখ্যাটাও কম নয়। বিদেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গাদের এই সংখ্যাটা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
আরব আমিরাতের আবুধাবী ও দুবাইয়ে দেখা মিলে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে। তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সেদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ করে পাসপোর্ট পেয়েছেন বলে তারা দাবি করেন। মেয়াদ শেষে দূতাবাস ও কন্সুলার অফিস থেকে নবায়নও করে নিয়েছেন, নতুন পাসপোর্টও করেছেন। তাদের মত অনেক রোহিঙ্গা আমিরাত, সৌদি আরবে বসবাস করছেন।
আবুধাবিতে শ্রমিকের কাজ করা রোহিঙ্গা মোশাররফ হোসেন জানান, তাদের পরিবার ২০০২ সালের দিকে রাখাইন থেকে কক্সবাজার আসে। সেখানে তিনি এক দোকানে চাকরি করত। দু’বছর পর ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট করে নেন। এক পর্যায়ে দুবাই পাড়ি দেন। সেই থেকে আর বাড়ি ফিরেননি। আরেক রোহিঙ্গা মতলব মিয়া জানান, তিনিও ৮/৯ বছর আগে দুবাই এসেছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে। শুধু এ দু’জন নয়, আরব আমিরাতে ২০ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে। আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, আজমান, রাস আল খাইমা, ফুজিরাহ, আল আইনসহ সব রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বসবাস।
একই সাথে সৌদি আরবে রয়েছে আরো কয়েকগুণ বেশি রোহিঙ্গা। সেখানে দেড় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক। ওমরাহ পালনের নামে গিয়ে আর ফেরত আসেননি হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে পাসপোর্ট পেতে যারা সহযোগিতা করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, কোনোভাবেই এই দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না।
তিনি গতকাল শুক্রবার সকালে সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, এরইমধ্যে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে পাসপোর্ট দেওয়ার কাজ করেন এমন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন ঘটনার খবর পেলেই সাথে সাথেই শাস্তির খড়গ নামবে জড়িতদের বিরুদ্ধে।
এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নেয়ার বিষয়টি বেশি ঘটেছে ২০০১ ও ২০০৩ সালের দিকে। তবে স¤প্রতিও যে ঘটছে না, তা হলফ করে বলতে পারি না। কেননা সব স্থানেই দুষ্ট লোক আছে, যারা খুব লোভী। এরাই জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার যার বিরুদ্ধে আসছে সাথে সাথে তাকে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, সৌদি আরব দূতাবাসে এমন একটি অভিযোগ ছিল। আমরা সাথে সাথেই তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এসব দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স।
রোহিঙ্গাদের যারা পাসপোর্ট দেবেন তাদের ছাড় নেই। কোনো তদবির আমরা গ্রহণ করি না। আপাতত তাদের প্রত্যাহার করে শাস্তি দিচ্ছি। তবে দোয়া করেন যেন এই দুষ্ট লোকের সংখ্যা কমে যায়।
বিভাগীয় পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক আবু সাঈদ জানান, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিলেও সন্দেহ হওয়ায় অনেক সময় আবেদনকারীর নাম-ঠিকানা পুনরায় তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। অতীতে দালাল কিংবা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনেকে নানা কায়দায় পাসপোর্ট করতে পারলেও এ ব্যাপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পর প্রবণতা অনেক কমে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করে দেয় এমন কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। এ চক্রে রয়েছেন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ও কর্মকর্তা, পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দালাল। তারা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরি করতে ৭০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যস্ত নেন।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা অনায়াসে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেয়ে যান। কোন কিছু যাচাই বাছাই না করেই রিপোর্ট দেন তারা।
জেলা পুলিশ সুপার নুরে এ আলম মিনা বলেন, রোহিঙ্গার যাতে পাসপোর্ট না পায় সেজন্য আমরা কঠোর অবস্থানে। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাই ছাড়া পজেটিভ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট না দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। সামান্য সন্দেহ হলেই রিপোর্ট দেয়া হয় না। বার বার যাচাই করা হয়। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছ থেকেও যাচাই করা হয়।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদেশ পাড়ি জমানোর বিষয়টি অস্বীকার করছে না সরকারও। গেল বছর আগস্ট মাসে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে আছেন। তারা আমাদের শ্রমিকদের বাজার দখল করছেন। নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগের মধ্যে থাকা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নেওয়া এবং বাংলাদেশি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথাও জানান মন্ত্রী।
শুধু দেশে নয়, বিদেশি বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও পাসপোর্ট করছেন রোহিঙ্গারা। আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে অবস্থিত দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট ও পুরাতনটা নবায়ন করে নিচ্ছেন। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দূতাবাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা কর্মচারির যোগসাজসে এগুলো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সৌদি দূতাবাসের বিরুদ্ধে এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে এক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারও করা হয়েছে।
আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ডা. মোহাম্মদ ইমরান বলেন, প্রবাসীদের সকল কাগজপত্র পাওয়ার পর তা যাচাই বাছাই করে তারপরই পাসপোর্ট দেয়া হয়। সে ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হয় না। কোন কাগজপত্র ত্রæটি থাকলে পাসপোর্ট সরবরাহ করা হয়নি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর নির্ভর করে পাসপোর্ট পাওয়া। পুলিশ পজেটিভ রিপোর্ট দিলেই কেবল পাসপোর্ট দেয়া হয়।
তাতে অস্বচ্ছতার কোন সুযোগ নেই।
সম্প্রতি সৌদি আরব সরকার রোহিঙ্গাদের সনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। গত বছর ৫০ রোহিঙ্গাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সেদেশের সরকার। তাদের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের সনাক্তকরণের কার্যক্রম শুরু করবে বলে জানা গেছে।