মিরসরাইয়ে প্রাণ গেল ১১ জনের

49

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ৭ জন। তাদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হতাহতরা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী। তাদের সবার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার আমান বাজারের খন্দকিয়ায়। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে মিরসরাই উপজেলার ১২নং খৈয়াছড়া ইউনিয়নের খৈয়াছড়া ঝর্না রোড এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, হাটহাজারীর আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল ৮টায় হাটহাজারীর আমান বাজার থেকে মাইক্রোবাসযোগে খৈয়াছড়া ঝর্নায় ঘুরতে যান। ঘোরাঘুরি শেষে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যেই আনন্দে ভ্রমণে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।
নিহতদের মধ্যে ৪ জন ঐ কোচিং সেন্টারের শিক্ষক, ৬ জন শিক্ষার্থী এবং ১ জন মাইক্রোবাসের চালক। নিহত শিক্ষকরা হলেন নগরীর লাইনম্যান কবিরের বাড়ির আবদুল হামিদের ছেলে জিয়াউল হক সজীব (২২), আজিজ মেম্বারের বাড়ির জানে আলমের ছেলে ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), আবু মুসা খান বাড়ির মোতাহের হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯) এবং মজিদ আব্বাস চৌধুরী বাড়ির বাদশা চৌধুরীর ছেলে রিদুয়ান চৌধুরী (২২), শিক্ষার্থীরা হলো বজল কন্ট্রাক্টর বাড়ির মোজাফফর আহমদের ছেলে মোসহাব আহমেদ হিসাম (১৬), বাছা মিয়া সওদাগর বাড়ির মনসুর আলমের ছেলে মো. মাহিম (১৭), পারভেজের ছেলে সাগর (১৭), আবদুল ওয়াদুদ মাস্টারের বাড়ির আবদুল মাবুদের ছেলে ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), আবদুস শুক্কুর লাইনম্যান কবিরের বাড়ি আয়াতুল ইসলাম (১৭), হাজী জালাল কোম্পানি বাড়ির মো. ইলিয়াছের ছেলে মোহাম্মদ হাসান (১৮) এবং গাড়িচালক নগরীর আবদুর আজিম সাব রেজিস্ট্রার বাড়ির হাজী মোহাম্মদ ইউসুফের ছেলে গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬)। আহতরা হলেন মাইক্রোবাসের হেলপার তৌকিদ ইবনে শাওন (২০), একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহিম (১৮), তানভীর হাসান হৃদয় (১৮), ইমন (১৯), এসএসসি পরীক্ষার্থী তছমির পাভেল (১৬), সৈকত (১৮)।

রেলক্রসিংয়ে গেট ফেলা নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য : গেটম্যানের অবহেলার কারণেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান সাদ্দামকে কেউ ঘটনাস্থলে দেখেননি। তার অবহেলার কারণে অকালে ঝরেছে ১১টি তাজা প্রাণ। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ট্রেন আসার সিগন্যাল পেয়ে ওই ক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দাম বাঁশ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছিলেন। সেই বাঁশ ঠেলে মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। এমনকি গেটম্যান লাল পতাকা উড়িয়ে মাইক্রোবাস চালককে থামার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন।
দুর্ঘটনার অদূরের বাসিন্দা নাছির উদ্দিন জানান, ‘দুর্ঘটনার আওয়াজ শুনে আমি দৌড়ে আসি, আসার পর দেখি গেট দেওয়া ছিল না।’
প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল ওয়াজেদ মামুন বলেন, ‘ঘটনার সময় গেটম্যান সাদ্দাম ছিলেন না। তার অবহেলার কারণে একসঙ্গে ১১ জন মারা গেছেন।’
গেটম্যান ছিলেন না বলে জনিয়েছেন ওই ট্রেনের যাত্রী কলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি ট্রেনে ছিলাম। দুর্ঘটনাস্থলে কোনো গেটম্যান ছিলেন না।’
রায়হান উদ্দিন নামে অপর বাসিন্দা বলেন, ‘শুনেছি গেটম্যান সাদ্দাম নামাজে ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তার অবহেলার কারণে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
প্রত্যক্ষদর্শী মফিজুল হক জানিয়েছেন, ‘দুর্ঘটনার সময় সেখানে কোনো গেটম্যান ছিল না। তিনি জুমার নামাজ আদায় করতে মসজিদে গিয়েছিলেন।’
মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া রেল স্টেশন মাস্টার শামছুদ্দোহা বলেন, ‘যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে ওখানকার গেটম্যানের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নাই। এটি আমাদের আওতায় নেই।’
তবে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী এই দুর্ঘটনায় মাইক্রোবাস চালকের অবহেলা ছিল দাবি করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী মহানগর আপ যাচ্ছিল। একই সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতীও মিরসরাই বড়তাকিয়া এলাকায় একই স্থান পারাপার হচ্ছিল। বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে মহানগর আপ ট্রেনটি যাওয়ার আগে ক্রসিংয়ের গেটে থাকা বাঁশ ফেলা হয়। এসময় মহানগর আপ বড়তাকিয়া ক্রস করার সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাসটি বাঁশ উল্টিয়ে ট্রেনের লাইনে উঠে পড়ে।’
তিনি আরো বলেন, ‘তারা মনে করেছিলেন, ঢাকা থেকে আসা ট্রেনটি আসার আগেই যেতে পারবেন। কিন্তু রেললাইনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতী ট্রেনটি চলে আসে এবং মাইক্রোবাসের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ঘটনার সময় গেটম্যান উপস্থিত ছিলেন। তিনি বারবার লাল পতাকা উচিয়ে তাদের বারণ করলেও মাইক্রো চালক শোনেননি। তার অবহেলার কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
৪ ঘণ্টা পর মাইক্রোবাস অপসারণ : ৪ ঘণ্টা পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিকেল ৫টায় বড়তাকিয়া রেল স্টেশন মাস্টার শামসুদ্দোহা এই তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করতে কাজ করে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের দুইটি টিম। তারা মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করে। এর আগে প্রায় ৩ ঘণ্টা চেষ্টা করেও মাইক্রেবাসটি রেললাইন থেকে সরাতে ব্যর্থ হয় মিরসরাই ও সীতাকুÐ ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন কর্মীরা।
৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক : আহতাবস্থায় ৬ জনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা হলেন তৌকিদ ইবনে শাওন (২০), তছমির পাভেল (১৬), মাহিম (১৮), সৈকত (১৮), তানভীর হাসান হৃদয় (১৮), ইমন (১৯), আয়াত (১৬)।
গেটম্যান আটক : মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় ১১ জন নিহতের ঘটনায় ওই রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৬ টার দিকে রেলওয়ে পুলিশ তাকে আটক করে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) আনছার আলীকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রেলের বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী-১ আবদুল হামিদ, বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (লোকো) জাহিদ হাসান, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট রেজানুর রহমান ও বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার (ডিএমও) আনোয়ার হোসেন।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনহাজুর রহমান জানান, হাটহাজারী থেকে আসা ওই মাইক্রোবাসে ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে ১১ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাকিদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার লাবিব আব্দুল্লাহ জানান, ট্রেন দুর্ধটনায় ঘটনাস্থলে ১১ জন নিহত হয়েছে। আহতদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ট্রেন দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও পূর্বাঞ্চল রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনছার আলী বলেন, ‘ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে এবং কারা দোষী সেই বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। তবে যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে। আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি। চেষ্টা করবো ৩-৪ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার।’