মিরসরাইয়ের ভাষা সৈনিকগণ তাঁরা কি বিস্মৃতির পথে?

20

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই

রক্তস্নাত ফেব্রুয়ারি আবারো ফিরে এলো বাঙালি জাতির জীবনে। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরেই যখন বাঙালির ভাষার ওপর আঘাত এলো, তখন বুকের রক্ত ঢেলে লেখা হলো এক নতুন ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল স্মৃতিমাখা এই মাস এলেই মনে ভিড় জমায় ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের নাম। ভাষা আন্দোলনের প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে মিরসরাইয়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৪ জন সদস্য ছিলেন মিরসরাইবাসী।
তাঁরা হলেন এটিএম শামসুদ্দীন, মফিজুল ইসলাম, রুহুল আমিন নিজামী, আহমেদুর রহমান আজমী। কবি মাহবুব আলম চৌধুরীর কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি’ লালদিঘীর ময়দানে পাঠের পর দ্বিতীয় বার পঠিত হয় মিরসরাইয়ে।
ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নেই নিজামপুর মুসলিম হাই স্কুুলে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ১১ বৎসর পর চট্টগ্রামে প্রথম যে শহীদ মিনার নির্মিত হয় তার স্থপতি ছিলেন মিরসরাইয়ের কামাল উদ্দিন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়তার কারণে সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, তাজুল ইসলাম জেল খাটেন। দেশখ্যাত ভাষা সৈনিক গাজিউল হক ৩ বার মিরসরাইয়ে সভা করে গেছেন।
ভাষা আন্দোলনে মিরসরাই নিয়ে লিখিত ইতিহাসগ্রন্থ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও স্মৃতিচারণে ২৭ জনের ভূমিকার কথা উঠে আসে।তাঁরা হলেন মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, সাংবাদিক নুরুল ইসলাম, সৈয়দুল হক, এটিএম শামসুদ্দীন, তাজুল ইসলাম, কামাল উদ্দিন, আবুল কালাম মাস্টার, কেফায়েত উল্ল্যাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আবু ছালেক, কাজী জাফরুল ইসলাম, তাহের আহম্মদ, ওবায়দুল হক খোন্দকার, মফিজুল ইসলাম, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী, রুহুল আমিন নিজামী, মানু ইসলাম, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, রত্নেশ্বর শীল, সামছুল হুদা, ছাবের আহম্মদ, চিত্ত শীল, ডা. জোৎস্নাময় চৌধুরী, ফকির আহমেদ বিএ, কবির মিয়া, আজিজুল হক মিয়া।
একসময় মিরসরাই একুশ উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে উপজেলা চত্বরে উপজেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বই মেলা, ভাষা সৈনিকদের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা ও ভাষা সৈনিকদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হতো। কিন্তু দীর্ঘসময় এই আয়োজন বন্ধ থাকায় মিরসরাইয়ের ভাষা সৈনিকদের জীবনচিত্র নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে না ধরার কারণে অনেকটাই ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম।
ভাষা সৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী
ভাষা সৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ১৯২৮ সালের ২ নভেম্বর ইছাখালী ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহতের খবর তিনি পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারেন পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। তিনি তখন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। ২৩ ফেব্রুয়ারি আজমীর নেতৃত্বে হাটহাজারী সদরে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল ও সমাবেশ। ওই সমাবেশ থেকেই মাওলানা আজমীকে আহব্বায়ক করে গঠিত হয় হাটহাজারী থানা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। অন্তর্ভুক্ত হন চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে। আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থাকার কথিত অপরাধে একাধিকবার জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আহমেদুর রহমান আজমীকে। তাকে প্রথম গ্রেপ্তার ও সাড়ে তিন বছর জেল দেওয়া হয় ১৯৫৯ সালে আইউব খানের সামরিক আইন ভাঙার দায়ে। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভাষার মাসে তিনি ইন্তেকাল করেন।

ভাষা সৈনিক সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সহচর ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহশিক্ষক ছিলেন ভাষা সৈনিক সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি। তিনি মায়ানী ইউনিয়নের পূর্ব মায়ানী গ্রামে ১৯২৮ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সক্রিয় ছিলেন ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে। সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বিএসসি বলে ডাকতেন। বহুবার একসঙ্গে জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজ হাতে লিখিত দিনলিপিতে তা লিখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার কারণে প্রথমবারের মতো কারাগারে অন্তরীণ হয়েছিলেন তিনি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানে বিএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তবে তাঁকে মুচলেকা দিতে হয়েছিল- পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হওয়া যাবে না। ১৯৯৯ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্ব-উদ্যোগে তাঁকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

ভাষা সৈনিক সাংবাদিক নুরুল ইসলাম
ভাষা সৈনিক সাংবাদিক নুরুল ইসলাম ১৯২৬ সালে ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা একুশের সংগ্রামের অংশ হিসেবে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বড়তাকিয়া রেল স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করেন। এজন্য তারা পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হন। তাঁদের নামে পুলিশ মামলা করে, দীর্ঘদিন হুলিয়া নিয়ে কাটান সাংবাদিক নুরুল ইসলাম। কিন্তু ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালের অন্যান্য আন্দোলন থেকে তিনি কখনো পিছিয়ে আসেননি। ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট এই ভাষা সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক সৈয়দুল হক
ভাষা সৈনিক সৈয়দুল হক ১৯১৪ সালে ইছাখালী ইউনিয়নের সাহেবদীনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় মিরসরাইতেও প্রভাব পড়ে। ছাত্ররা মিছিলে বেরিয়ে পড়ে, পুলিশও বসে থাকেনি। গড়পড়তা ধরপাকড় শুরু করে। বিশেষত রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের হেনস্তা করতে পুলিশ ও আনসার বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে আনসারদের অত্যাচার ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যেহেতু তারা কিছুদিন আগেও মুসলিম লীগের ক্যাডার ছিল তাই কাদের কাদের হেনস্তা করা যায় সেটা তাদের জানা ছিল। পুলিশ ও আনসার এসে একদিন সৈয়দুল হকের বাড়িতে হামলা দিল। ঘরের সবকিছু তছনছ করে আলামিরা বাক্স সিন্দুক খুলে কাপড়চোপড় ঘেটে কাগজপত্র সব টান মেরে ফেলে দিল। সন্দেহজনক দু’চারটা বই তুলে নিয়ে গেল। তার ভেতর ম্যাস্কিম গোর্কীর মা বইটি ছিল। তিনি তখন আত্মগোপনে ছিলেন। মূলত ১৯৫২ সালের মিরসরাইর ভাষা সৈনিকদের পুরোভাগে ছিলেন সৈয়দুল হক। ভাষা আন্দোলনে তার ভ‚মিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। ১৯৮৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই ভাষা সৈনিক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

ভাষা সৈনিক এটিএম শামসুদ্দীন
ভাষা সৈনিক এটিএম শামসুদ্দীন ১৯২৭ সালের ২ মার্চ ইছাখালী ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যতদিন তিনি মিরসরাইয়ে ছিলেন তরুণদের ভেতরে নানা বিষয়ে অদম্য উৎসাহ ও প্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন ১৯৫২ সালে, কমিউনিষ্ট পার্টির তখনকার দিনে সদস্য পদ সহজ ছিল না। এটিএম শামসুদ্দীন মাথায় হুলিয়া নিয়ে কখনও কৃষক, কখনও জেলে বেশে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে কাজ করে যান। মিরসরাইয়ের ভাষা সৈনিক হিসেবে বলা যায় সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁর দুঃখ-কষ্ট ও পুলিশের তাড়া প্রতিক্রিয়াশীলদের ভ্রল-ত্রুটি উপেক্ষা করে মিরসরাইয়ের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরেছেন। ২০০৯ সালে ভাষা সৈনিক এটিএম শামসুদ্দীন মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক তাজুল ইসলাম
ভাষা সৈনিক তাজুল ইসলাম ১৯৩৪ সালে ইছাখালী ইউনিয়নের সাহেবদীনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। টগবগে তরুণ তাজুল ইসলাম সেই আন্দোলনে জড়িত হয়ে লেখাপড়ার পাঠ সেখানে চুুকিয়ে দেন। ১৯৫২ সালে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াকালীন ছাত্ররা মিলে প্রতিবাদ মিছিল করেন। এরপর পুলিশ মিছিলে অংশ নেওয়া অনেক ছাত্রকে আটক করে। ভয়ে বাকিরা সবাই আত্মগোপন করতে লাগলেন। ২২ ফেব্রæয়ারি ট্রেনে করে মিরসরাইয়ের গ্রামের বাড়িতে রওনা দেন তাজুল ইসলাম। ভাষা আন্দোলনের খবরটি সারাদেশের মতো মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল আবুরহাটেও ছড়িয়ে পড়ে। আবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ছাত্রদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো এবং সমাবেশের পর সবাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার জন্য একমত হন। পরিষদের সভাপতি করা হয় তাজুল ইসলামকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় শান্তিরহাট এলাকার সাহাব মিয়াকে। শুরু হয় মিছিল, সভা, পোস্টারিং। মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাতে হেঁটে হেঁটে পোস্টার সাঁটানো হতো, প্রতি রাতে বসতো গোপন বৈঠক। আবুরহাট ঈদগাহ্ ময়দান ছিল এলাকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে ভাষা সৈনিক গাজিউল হক ৩ বার সভা করে গেছেন। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারনে তাজুল ইসলাম ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন এবং চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী ছিলেন। সেখানে তিন মাস থাকার পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেড় বছর পর মুক্তি পেয়ে চাকরির চেষ্টা করলেও কোথাও স্থায়ী হওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ যখনই কোনো আন্দোলন শুরু হতো তখন পুলিশী হয়রানী থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপন করতে হতো তাঁকে। সর্বশেষ ৫৮ সালে পুলিশি হয়রানী থেকে বাঁচার জন্য অনিচ্ছা সত্বেও পরিবারের সদস্যদের চাপে খুলনায় বেসরকারি সংস্থায় যোগ দেন। ছয় সন্তানের জনক এই ভাষা সৈনিক জীবিতকালে বিভিন্ন সম্মাননা ও স্বীকৃতি লাভ করেন।

ভাষা সৈনিক কামাল উদ্দিন
ভাষা সৈনিক কামাল উদ্দিন ১৯৩৮ সালে মিরসরাই পৌরসভার নাজিরপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে মিরসরাইয়েও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর মিরসরাইয়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, আবুল কালাম মাস্টার, এটিএম শামসুদ্দীন, তাজুল ইসলামসহ অনেকের নেতৃত্বে মিরসরাইয়ে হয় মিছিল, মিটিং। ওই আন্দোলনে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সরাসরি যুক্ত হন কামাল উদ্দিন। অংশ নেন বড়তাকিয়ায় রেললাইন উপড়ে ফেলার মিশনে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী মিরসরাই সদর, বড়তাকিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব আন্দোলন কর্মসূচী পালিত হয়েছে সেসব আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছেন কামাল উদ্দিন। চট্টগ্রামের প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনারের স্থপতি কামাল উদ্দিন। ভাষা আন্দোলনের ১১ বছর পর চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় ১৯৬২ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ এই শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এটি নির্মাণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন মিরসরাইয়ের কৃতি সন্তান চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কামাল উদ্দিন। তাকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মাহবুবুল আলম তারা মিয়া, জিএস শহীদ আসগর চৌধুরী, বার্ষিকী সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, মিরসরাইয়ের সন্তান কাজী জাফরুল ইসলামসহ আরো অনেকেই। পুলিশের ভয়ে রাতের অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ছাত্র সংসদের কয়েকজন নেতা ও কলেজের পিয়ন মোজাফ্ফর আহম্মদের সহযোগিতায়। ১ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক এই ভাষা সৈনিক ২০০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক আবুল কালাম মাস্টার
ভাষা সৈনিক আবুল কালাম মাস্টার মিরসরাইয়ের ভাষা আন্দোলনের একজন সেরা অগ্রনায়ক, মিরসরাই রাজনীতির সূত্রপাত থেকে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি মিরসরাইয়ে ভাষা আন্দোলন কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলনকে গতিময় করতে যুব মানসে অপূর্ব সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। তিনি আবুল কাশেম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, ভাষা আন্দোলনের জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে মিরসরাইয়ের তৃণমূলে ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষাপটে মিরসরাইয়ের পূর্বের রেললাইন উৎপাটন ও একটি চলন্ত ট্রেনকে লাইনচ্যুত করা ছিল উল্লেখযোগ্য। আর এতে নেতৃত্ব দেন মাস্টার আবুল কালাম এবং সাংবাদিক নুরুল ইসলাম।

ভাষা সৈনিক কেফায়েত উল্ল্যাহ মিয়া
ভাষা সৈনিক কেফায়েত উল্ল্যাহ মিয়া ১৯২৪ সালে কাটাছরা ইউনিয়নের মুরাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি অনন্য ভ‚মিকা রাখেন। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি এই অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। আজীবন সংগ্রামী ও প্রচারবিমুখ এই গুণী ব্যক্তি ১৯৯৬ সালের ২৯ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম চৌধুরী
ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আবুল কাশেম চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি স্থানীয়ভাবে ভূমিকা রাখেন। সুদীর্র্ঘ সময় তিনি মুক্তারী করেছেন বলে জনসাধারণের নিকট তিনি কাশেম মুক্তার নামে পরিচিত ছিলেন।

ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আবু ছালেক
ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আবু ছালেক ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে কাটাছরা ইউনিয়নের কাটাছরা গ্রামের আব্দুস সাত্তার ভ‚ঁইয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মিরসরাইয়ে ভাষা আন্দোলনে তিনি অনন্য ভ‚মিকা রাখেন।

ভাষা সৈনিক কাজী জাফরুল ইসলাম
ভাষা সৈনিক কাজী জাফরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর হাইতকান্দি ইউনিয়নের হাইতকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি স্কুল ছাত্র ছিলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে তিনিও প্রভাবিত হন। ১৯৫৮ সালে ডিগ্রি পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন এবং বহিরাগত ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬২ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে অন্যতম ভ‚মিকা পালন করেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণের পর চট্টগ্রাম নগরীর অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শহীদ মিনার নির্মাণ এবং বড় পরিসরে একুশ ফেব্রুয়ারি পালন শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ৭৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক তাহের আহম্মদ
ভাষা সৈনিক তাহের আহম্মদ ১৯৩৩ সালে হিঙ্গুলী ইউনিয়নের পূর্ব হিঙ্গুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মিরসরাই উপজেলা পরিষদের সর্বপ্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন।

ভাষা সৈনিক ওবায়দুল হক খোন্দকার
ভাষা সৈনিক ওবায়দুল হক খোন্দকার ১৯২৩ সালে করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলনে অংশ নেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনাকালীন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে তাকে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তিনি ফেনী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালের ২২ মার্চ ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক মফিজুল ইসলাম
চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে যুক্ত ছিলেন ভাষা সৈনিক মফিজুল ইসলাম। তিনি তখন আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিষয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের যোগ দেন। তার পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লা জেলার বুডিচং উপজেলায়। ছাত্র জীবনে তিনি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। মিরসরাইয়ে এসে এ আদর্শের সঙ্গী সাথীদের পেয়ে এখানে থেকে যান এবং মিরসরাইকে আপন কর্মক্ষেত্র করে এখানকার মানুষের মধ্যে প্রীতি ও সখ্যতা গড়ে তোলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আবুতোরাব ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে ভাষা আন্দোলনের কর্মকান্ড অবারিত হয়েছিল। আশির দশকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ভাষা সৈনিক মঈনুল আহসান সিদ্দিকী
ভাষা সৈনিক মঈনুল আহসান সিদ্দিকী ওচমানপুর ইউনিয়নের বৃন্দাবনপুর গ্রামের সৈয়দুর রহমান মোক্তার বাড়ি প্রকাশ আজিম মুহুরী বাড়িতে ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন মন্টু ভাই হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক এর চট্টগ্রাম সংবাদদাতা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ভাষা সৈনিক মন্টু ভাই চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ২ বছরের জন্য বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃক সংবর্ধিত হন।

ভাষা সৈনিক রুহুল আমিন নিজামী
ভাষা সৈনিক রুহুল আমিন নিজামীর জন্ম দুর্গাপুর ইউনিয়নের চৌধুরীহাট এলাকায়। তিনি চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে যুক্ত ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মিরসরাইয়ে রুহুল আমিন নিজামীর ভ‚মিকা ছিল অনন্য। অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের সঙ্গে তিনিতো ছিলেনই, তাছাড়া তাঁর উদয়ন পত্রিকাতে কয়েকবার একুশ উদ্যাপনের বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

ভাষা সৈনিক নুরুল ইসলাম প্রকাশ মানু ইসলাম
ভাষা সৈনিক নুরুল ইসলাম প্রকাশ মানু ইসলাম ১৯৩৭ সালে কাটাছরা ইউনিয়নের বাড়ীয়াখালী গ্রামের রেয়াজ উদ্দিন মুহুরী বাড়ির সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম নুরুল ইসলাম হলেও তিনি মানু ইসলাম নামে পরিচিত ছিলেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জড়িত ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে তিনি মিরসরাই-সীতাকুÐে মূল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে জনমত সৃষ্টি করার জন্য মিঠাছড়া, আবুতোরাব, দুর্গাপুর, আবুরহাট, করেরহাট, মহাজনহাট, শান্তিরহাট, গোলকেরহাট, আজমপুর, ইছাখালীসহ বিভিন্ন এলাকয় সভা সমাবেশ করেন। এসব সমাবেশে তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিতেন।

ভাষা সৈনিক নুরুল আনোয়ার চৌধুরী
ভাষা সৈনিক নুরুল আনোয়ার চৌধুরী মিরসরাইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার চট্টগ্রাম কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণের সময় অনন্য ভ‚মিকা পালন করেন। সেসময় তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ইউএসটিসি নেতা ছিলেন।

ভাষা সৈনিক রত্নেশ্বর শীল
ভাষা সৈনিক রত্নেশ্বর শীল দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দুর্গাপুর নগেন্দ্র চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ছিলেন সূর্যসেনের কিশোর সাথী, মিরসরাইয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির উদ্যোক্তা। ছিলেন যুব বিদ্রোহের সদস্য, বৃটিশবিরোধী আন্দোলন ও ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এছাড়া ভাষা সৈনিক সামছুল হুদা, ছাবের আহম্মদ, চিত্ত শীল, ডা. জোৎস্নাময় চৌধুরী, ফকির আহমেদ বিএ, কবির মিয়া, আজিজুল হক মিয়ার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভাষা সৈনিক মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমীর ছেলে জাহেদ রফিক বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হয়েছে। আমি চাই দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের জিইয়ে রাখা যাবে অনন্তকাল। শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশ তথা ভাষার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা ছাড়া একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কখনও মূলধারায় আসতে পারে না। পাশাপাশি ভাষা সৈনিক ও ভাষা শহীদদের জীবনী, তাঁদের বীরত্ব নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আহবান জানাবো’।
মিরসরাই উপজেলা মহান একুশ উদ্যাপন পরিষদের সাবেক মহাসচিব শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘ভাষা শহীদ ও ভাষা সৈনিকদের সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে জানানোর অন্যতম একটি প্রক্রিয়া একুশ উদ্যাপন উপলক্ষে বই মেলা ও আলোচনা সভা। মিরসরাইয়ে একুশ উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে একাধিকবার উপজেলা পরিষদ চত্বরে একুশ উদ্যাপন করা হয়েছে। এসময় উপজেলার শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বই মেলা, ভাষা সৈনিকদের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা ও ভাষা সৈনিকদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘসময় এটির আয়োজন না হওয়ায় আমাদের আগইম প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে’।